ভারতে সংবিধানের স্থানটিই সর্বোচ্চ, মনে করিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ভূষণ রামকৃষ্ণ গাভাই। যদি আইনসভা কিংবা সরকার তাদের নির্দিষ্ট কর্তব্য করতে ব্যর্থ হয়, তা হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে বিচারবিভাগকেই। আপাতদৃষ্টিতে কথাগুলিতে অভিনবত্ব কিছু নেই। সরকারের কাজের ফলে যদি সাংবিধানিক নীতি অসম্মানিত হয়, আইনের সীমা লঙ্ঘিত হয়, তা হলে আদালতকেই পদক্ষেপ করতে হবে। এমনকি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শাসন বা আইনবিভাগকে নির্দেশ দেওয়ার অধিকারও রয়েছে আদালতের। তা সত্ত্বেও যে প্রধান বিচারপতি এ কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তার প্রেক্ষিতটি অত্যন্ত জরুরি। তামিলনাড়ুর বেশ কয়েকটি বিল পাশে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যে দেশের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র পেশ করেছেন। পত্রের বিষয়বস্তু— রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উপর আদালতের হস্তক্ষেপের এক্তিয়ার। তামিলনাড়ু সরকার বনাম তামিলনাড়ু রাজ্যপাল (২০২৩) মামলায় গত ৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, রাজ্য সরকার কোনও বিল রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালে তা অনির্দিষ্ট কাল আটকে রাখা যাবে না, তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। আরও বিলম্ব হলে তার কারণ জানাতে হবে। কারণ না দর্শিয়ে বিল বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা যে যথেচ্ছ (আর্বিট্রারি) ক্ষমতাপ্রয়োগের উপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞার পরিপন্থী, সে কথাও উল্লেখ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এ নিয়ে বিতর্ক উপস্থিত হওয়ার কারণেই প্রধান বিচারপতির সংবিধান সম্পর্কিত এই সতর্কীকরণ।
বুঝতে অসুবিধা নেই, গণতন্ত্রের তিন স্তম্ভের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিতর্ক তৈরি হওয়াও স্বাভাবিক। বস্তুত, বিতর্কের পরিসর তৈরি হওয়া— গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ। তবু সমস্যা তৈরি হয়েছে, গুরুতর সমস্যা। কেননা, এই প্রসঙ্গে উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় আদালতের ভূমিকা নিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যাকে বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার প্রকাশ বলে মনে হতে পারে। সংবিধানের ১৪২ ধারা, যা সুপ্রিম কোর্টকে বিবেচ্য বিষয়ে ‘সম্পূর্ণ ন্যায়’ করার ক্ষমতা দিয়েছে, তাকে ‘আণবিক অস্ত্রের মতো’ ব্যবহার করছেন বিচারপতিরা— এই ভাষা দেশের উপরাষ্ট্রপতির কাছে প্রত্যাশিত নয়। ধনখড় এ-ও বলেছেন যে ভারতে আইনসভার স্থান সর্বোচ্চ (সুপ্রিম)। ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত তিনি। তাঁর এই বক্তব্যে শীর্ষ আদালতের প্রতি যে অসম্মানের সুর— গণতন্ত্রের পক্ষে তা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। সম্ভবত সেই কারণেই প্রধান বিচারপতির পদে আসীন হওয়ার আগেই সংবিধান, এবং বিচারবিভাগের মর্যাদার রক্ষায় সরব হতে হয়েছিল বিচারপতি গাভাইকে। প্রধান বিচারপতি হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করার পর তিনি আবারও মনে করালেন, ভারতে সর্বোচ্চ স্থানটি সংবিধানের। তার চৌহদ্দির মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে আইনসভা, সরকার এবং বিচার বিভাগকে, আপন আপন সীমার মধ্যে আবদ্ধ থেকে।
যখন সরকার নিষ্ক্রিয় থাকে, অথবা আইনসভা নিজের কর্তব্য করে না, তখনই আদালত নিজের নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যেতে বাধ্য হয়। গণতন্ত্রের সুরক্ষার অর্থ ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা। আইনের ব্যাখ্যাই আদালতের কাজ, প্রণয়নের কাজ আইনসভার। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র, যেখানে আইন না-থাকার জন্য নাগরিকের সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার বিঘ্নিত হচ্ছে, সেখানে আদালত পদক্ষেপ করতে পারে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিবারণ (১৯৯৭) সুপ্রিম কোর্টের রায়েই প্রথম আইনি রূপ পেয়েছিল, প্রায় দেড় দশক পরে সংসদ এ বিষয়ে আইন পাশ করে। আদালতের অতি-সক্রিয়তা থেকে গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে সরকারকে তৎপর ও সক্রিয় হতে হবে। আইনসভা বা সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকারের যুক্তিহীন কাজ, বা নিষ্ক্রিয়তাকে বৈধ বলে প্রতিষ্ঠা করা চলে না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)