E-Paper

এখনও বহু দূর

অসমতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাঁড়িপাল্লার ‘ভুল’ প্রান্তে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতার সিঁড়িরও নীচের ধাপের বাসিন্দা। পরিবার বা সমাজ তো বটেই, গোটা দুনিয়াতেই— বিশেষত অনুন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বে— রাষ্ট্রযন্ত্রও আসলে পরিচালিত হয় পুরুষতন্ত্রের যুক্তিতে।

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:১১

কথা ছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে গোটা দুনিয়াকে প্রকাশ্যে মলত্যাগের ঘটনা থেকে মুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, সুস্থায়ী উন্নয়নের এই লক্ষ্যটি সম্ভবত পূরণ হওয়ার নয়। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দুনিয়ার আরও ১২০ কোটি মানুষের নাগালে এসেছে বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার। এখন বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫৮ শতাংশ তেমন শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু, রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান বলছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে প্রকাশ্য মলত্যাগের প্রবণতা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে চার গুণ বেশি। উন্নত দেশগুলি কার্যত প্রকাশ্য মলত্যাগের ঘটনাহীন। লাতিন আমেরিকা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াও এই প্রবণতা থেকে কার্যত মুক্ত। সাহারা মরুভূমির উত্তরে অবস্থিত আফ্রিকার দেশগুলি, এবং পশ্চিম এশিয়াতেও এই প্রবণতা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছে। বাকি রয়েছে দু’টি অঞ্চল— এক, সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত আফ্রিকার দেশগুলি; এবং দুই, দক্ষিণ এশিয়া। বিশ্বের উন্নয়ন মানচিত্রের দুই অন্ধকার কেন্দ্র। এবং, এই দু’টি অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত বৃহত্তম দেশটির নাম ভারত। গত এক দশকে ভারত প্রকাশ্যে মলত্যাগের প্রবণতা রোধ করার পথে বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়েছে, এ কথা যেমন সত্য, তেমনই একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, এখনও বহু পথ চলা বাকি। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, এখনও প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত প্রকাশ্যে মলত্যাগ করেন। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো অঞ্চলে এখনও প্রতি পাঁচটি বাড়ির মধ্যে একটিতে কোনও রকম শৌচাগার নেই। স্বচ্ছ ভারত যে এখনও বহু দূরের গন্তব্য, নেতারা সে কথাটি স্বীকার করলে উপকার হয়।

রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান থেকে এ বিষয়ে বৈষম্যের যে ছবিটি বেরিয়ে আসছে, তা শুধু উন্নত বনাম অনুন্নত দুনিয়ার মধ্যে নয়। অনুন্নত দুনিয়াতেও প্রকাশ্যে মলত্যাগের প্রবণতার মধ্যে বিস্তর প্রভেদ রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি সহজবোধ্য— যেমন, ধনীদের তুলনায় গরিবদের মধ্যে প্রকাশ্যে মলত্যাগের প্রবণতা বেশি। কারণ, ধনীদের পক্ষে বিজ্ঞানসম্মত নিরাপদ শৌচাগার নির্মাণ করা, অথবা তার নাগাল পাওয়া অনেক সহজ। তেমনই, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে প্রকাশ্যে মলত্যাগের প্রবণতা বেশি। এর একটি কারণ শৌচাগারের অভাব; আর একটি কারণ অভ্যাস। কিন্তু, সংখ্যাগরিষ্ঠের তুলনায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রকাশ্যে মলত্যাগের প্রবণতা বেশি কেন, শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকেই বা কেন তুলনায় অধিকতর ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে মলত্যাগ করতে হয়, অথবা মহিলা বা শিশুরা কেন পুরুষদের তুলনায় বেশি প্রকাশ্যে মলত্যাগ করতে বাধ্য হয়, সেই প্রশ্নগুলির উত্তর সহজে মেলে না।

অথবা, এই প্রশ্নগুলিও একই রকম সহজ। অসমতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাঁড়িপাল্লার ‘ভুল’ প্রান্তে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতার সিঁড়িরও নীচের ধাপের বাসিন্দা। পরিবার বা সমাজ তো বটেই, গোটা দুনিয়াতেই— বিশেষত অনুন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বে— রাষ্ট্রযন্ত্রও আসলে পরিচালিত হয় পুরুষতন্ত্রের যুক্তিতে। আর, সংখ্যালঘুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ তো দক্ষিণপন্থী শাসনের চরিত্রলক্ষণ। অন্য যে কোনও জিনিসের মতোই শৌচাগারের প্রশ্নটিও শেষ অবধি রাজনৈতিক— কিছু ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি; কিন্তু অধিকতর ক্ষেত্রে বৃহত্তর অর্থে রাজনীতির প্রশ্ন। সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত জনপদ বাদ পড়ে যেতে থাকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন মানচিত্র থেকে; অথবা, যে পরিবার কোনও একটি মাপকাঠিতে প্রান্তিক, রাষ্ট্রীয় সুবিধাগুলিও শেষ অবধি তার কাছে পৌঁছয় না। উচ্চবর্ণের ক্ষমতাতন্ত্র এখনও বহু ক্ষেত্রেই মনে করে যে, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য, অথবা জনজাতিভুক্ত মানুষের জন্য শৌচাগার এখনও একটি বিলাসিতামাত্র— ‘ওদের ও সব না দিলেও চলে’। অনুন্নয়নের বোঝা পিছিয়ে থাকা মানুষকেই বয়ে চলতে হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Washroom latrine Urine

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy