E-Paper

আশ্বাস ও বিশ্বাস

আশ্বাসের পাশাপাশি নির্দেশ, চাকরিহারা শিক্ষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষাদান করুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে অতি স্বাভাবিক নির্দেশ। আবারও তিনি পরিস্থিতি ‘ম্যানেজ’ করছেন, ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন।

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৪২

মিথ্যা কথা আর ভুল কথার মধ্যে একটি গুণগত তফাত আছে। তবে মিথ্যা ও ভুল দুই-ই যখন এক মোড়কে পরিবেশিত হয়, তার একটি অন্যতর, বৃহত্তর অভিধা তৈরি হতে পারে: প্রতারণা। সম্প্রতি এসএসসি-কাণ্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বার্তা দিলেন, তার জন্য এই শব্দটিই হয়তো সবচেয়ে প্রযোজ্য। এত বড় সরকারি দুর্নীতির পর সরকারের প্রধান হিসাবে তিনি এতটুকু লজ্জিত বা বিড়ম্বিত বলে মনে হল না, বরং স্পর্ধিত উচ্চারণে আবারও তাঁকে অবিরত আশ্বাস দিতে দেখা গেল, যে আশ্বাসের বিন্দুমাত্র বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। তিনি যখন বললেন যে তিনি বেঁচে থাকতে কারও চাকরি যেতে পারে না, তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার বুদবুদ মুহূর্তে ফেটে গেল। সত্যিই যদি তাঁর হাতে ‘এ বি সি ডি’ ইত্যাকার ‘প্ল্যান’ প্রস্তুত থাকত, তা হলে তিনি হয়তো স্পষ্টাক্ষরে তা বলতেও পারতেন। বলতে যে পারলেন না তার কারণ সে কাজ সহজ তো নয়ই, সম্ভব কি না তাতেও ঘোর সন্দেহ। শিক্ষা-প্রশাসনের দুর্নীতি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে প্রায় ছাব্বিশ হাজার মানুষের চাকরি এক ধাক্কায় চলে গিয়েছে, যাদের এক বিরাট অংশ নির্দোষ, অর্থাৎ ‘যোগ্য’। কী পদ্ধতিতে তাদের প্রকৃত দোষী অর্থাৎ ‘অযোগ্য’দের থেকে আলাদা করা যাবে, তার কোনও দিশা কারও কাছে নেই, থাকলে তা আগেই করা যেত। এমন কোনও বিকল্প কল্পনা করাই মুশকিল যাতে ‘যোগ্য’দের প্রতি সুবিচার ও ‘অযোগ্য’দের শাস্তি একই সঙ্গে সম্ভব হতে পারে। প্রকৃত অপরাধী— অর্থাৎ যে রাজনৈতিক নেতা কর্তা কর্মীদের সীমাহীন অর্থলোলুপতায় এমন ঘটল— তাঁদের বিচারের আঙিনায় টেনে আনা প্রায় অসম্ভব। এই বিপুল আয়তনের দুর্নীতি সম্বন্ধে রাজ্যের শীর্ষ নেত্রী ও নেতারা অনবহিত ছিলেন, এও ভাবা অসম্ভব। অথচ নিজেরই সরকারের এই ঘোর অপরাধ জনসমক্ষে উন্মোচিত হওয়ার পরও স্টেডিয়াম-ভাষণের পর মুখ্যমন্ত্রীর ‘মানবিক মুখ’ নিয়ে খোদ শিক্ষামন্ত্রী থেকে দলীয় তাঁবেদারসমূহ উদ্বেলিত গদগদ। এবং সেই নেত্রীস্তবের আবহে ধ্বনিত হল— আশ্বাস।

আশ্বাসের পাশাপাশি নির্দেশ, চাকরিহারা শিক্ষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষাদান করুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে অতি স্বাভাবিক নির্দেশ। আবারও তিনি পরিস্থিতি ‘ম্যানেজ’ করছেন, ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তিনি ও তাঁর সরকার ইতিমধ্যেই প্রমাণ করে দিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গে এখন প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে, পাশাপাশি সমান্তরাল ব্যবস্থা চালু করাই হল প্রশাসনিক ‘ম্যানেজ’ কর্মকাণ্ডের ধারা। পুরকর্মী থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, সকলকেই অস্থায়ী ভিত্তিতে এবং দলীয় সংগঠনের উপর নির্ভরতার ভিত্তিতে নিয়োগ করলে এক ঢিলে অনেকগুলি ফললাভ। তাতে যোগ্যতা বিচার অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া যায়, নিয়মবহির্ভূত অর্থাগমের ব্যবস্থা করা যায়, বিপুল সমর্থক সমাজের মধ্যে ‘সিস্টেম’-এর বদলে, ‘সিস্টেম’-এর বাইরে, পার্টি মুখাপেক্ষিতার পাকাপাকি বন্দোবস্ত সম্ভব হয়। তাই সিভিক ভলান্টিয়ার, পার্শ্বশিক্ষকের পর এখন হয়তো ‘সিভিক শিক্ষক’ তৈরির পালা। এই সিস্টেম-ধ্বংসকারী সমান্তরাল ব্যবস্থা নির্মাণ বর্তমান শাসনের একটি বিশিষ্ট ‘অবদান’। ‘সুপারনিউমেরারি’ বা অতিরিক্ত শূন্যপদ বন্দোবস্তকেও সেই প্রেক্ষাপটে দেখা সম্ভব। এসএসসি-র সিস্টেমকে এড়িয়ে আলাদা এই তালিকার ভাবনায় মন্ত্রিসভার সিলমোহর কিংবা রাজ্যপালের স্বাক্ষর থাকতেই পারে, তার ভিত্তিতে আদালতের রায়ে আজ তা ছাড়ও পেতে পারে। তবে রাজনৈতিক ও সামাজিক নৈতিকতাকে পদদলনের দায় থেকে তা কোনও মতেই মুক্ত হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বারংবার বার্তা দিচ্ছেন যে তাঁরা চাকরিহারাদের ‘পাশে রয়েছেন’। তাঁদের বোঝা দরকার, মানবিক আস্থা কিংবা মহৎ আশ্বাস বিতরণের উচ্চভূমি থেকে তাঁরা বিচ্যুত হয়েছেন। এই বিপুল অপরাধের দায় সর্বাংশে স্বীকার করলে তবেই একমাত্র তাঁরা ‘পাশে’ জায়গাপেতে পারেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mamata Banerjee Bengal SSC Recruitment Case School Teachers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy