দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে সুদের হার কমাল ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। ০.২৫ দশমিক-বিন্দু কমে ব্যাঙ্কের রেপো রেট এসে দাঁড়াল ৬.২৫ শতাংশে। সুদের হার কমা অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পক্ষে সচরাচর সুসংবাদ। কিন্তু, কয়েকটি কথা মাথায় রাখা ভাল। প্রথমত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ইতিমধ্যেই সুদের হার কমিয়েছে, এবং সুদ কমানোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক চাপ ছিলই। ভারত সে পথে হাঁটল। দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসাবে শক্তিকান্ত দাসের অবসরগ্রহণের পরে সঞ্জয় মলহোত্র সেই পদে আসীন হয়েছেন— এবং, তাঁর নেতৃত্বে এই প্রথম মনিটরি পলিসি কমিটির বৈঠক ছিল। শক্তিকান্ত দাসের আমলেই আমেরিকা-সহ একাধিক দেশ সুদের হার ছাঁটতে আরম্ভ করে। শ্রীদাস সেই পথে হাঁটতে সম্মত হননি। দিল্লি ও মুম্বইয়ের অর্থনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে গুজব ছিল, সুদের হার কমানোর প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অমতের কারণেই ব্যাঙ্কের শীর্ষপদে আরও এক দফা মনোনয়ন পেলেন না শ্রীদাস। শক্তিকান্ত দাসের আমল থেকে সঞ্জয় মলহোত্রর আমলে মূল্যস্ফীতির হার খানিক কমেছে বটে, কিন্তু অর্থব্যবস্থার সামগ্রিক ছবিটি বৈপ্লবিক রকম আলাদা, এমন দাবি করা যাবে না। ফলে, সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্তে কেউ নয়াদিল্লির প্রভাব খুঁজতে পারেন। জল্পনাটি সত্য হলে তা অবশ্য দুর্ভাগ্যজনক— কারণ, মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত যদি দিল্লির রাজনৈতিক চাপে প্রভাবিত হয়, তবে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ভারসাম্যটিই নষ্ট হয়ে যাবে।
আরও একটি বিষয় নজরে পড়বেই। ব্যাঙ্ক যে দিন সুদ কমানোর কথা ঘোষণা করল, তার দিনকয়েক আগেই অর্থমন্ত্রী বাজেটে বিস্তর কর ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছেন। এত দিনের আলোচনায় স্পষ্ট যে, অর্থমন্ত্রী যে শ্রেণিকে ‘মধ্যবিত্ত’ বলে ডাকছেন— প্রকৃতপক্ষে আয়করদাতাদের মধ্যে যাঁরা আয়ের নিরিখে দেশের উচ্চতম দশ শতাংশের অন্তর্ভুক্ত— কর ছাড়ের ফলে অতঃপর প্রতি মাসে তাঁদের হাতে গড়ে হাজার পাঁচেক টাকা বাড়তি থাকবে। অর্থমন্ত্রীর আশা, এই টাকার সিংহভাগ খরচ হবে ভোগব্যয়ে। চাকরির বাজারে এখনও যে পরিমাণ অনিশ্চয়তা, সেখানে সরকারি চাকুরে ছাড়া অন্যরাও হাতে আসা বাড়তি টাকার সিংহভাগ ভোগব্যয় করবেন, এই আশার মধ্যে নিশ্চয়তা কতখানি, সে প্রশ্ন থাকছে। কিন্তু, অর্থমন্ত্রীর যুক্তিকেই সত্য জ্ঞান করলে, এই বাড়তি খরচের সামর্থ্য বাজারে চাহিদা বাড়াবে। সুদের হার কমল তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই— এবং, বাজারের আশা স্পষ্ট যে, ভবিষ্যতে আরও সুদ কমবে। অর্থাৎ, বর্ধিত চাহিদা মেটাতে নতুন লগ্নি হবে, তার পথ সুগম করতেই ব্যাঙ্ক সুদ কমাল। কেন্দ্রীয় সরকার যখন কেবলমাত্র মুদ্রানীতির ভরসায় না থেকে রাজস্বনীতির মাধ্যমে চাহিদা বাড়ানোর কথা ভাবছে, তখন তার সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রাখার সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানানোই বিধেয়।
তবে, কিছু প্রশ্ন থাকছেই। মনিটরি পলিসি কমিটির আগের বৈঠক অবধি ব্যাঙ্কের আশঙ্কা ছিল যে, মূল্যস্ফীতির হার এখনও যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে আসেনি, ফলে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্তে বিপরীত ফল হতে পারে। ঘটনা হল, অক্টোবরের পর থেকে দেশে খুচরো পণ্যের মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার আপাতত নিম্নগামী। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও আপাতত নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু, শুধুমাত্র ২০২৪ সালের মূল্যস্ফীতির তথ্য দেখলেও স্পষ্ট হয় যে, কোনও এক বা দু’মাস এই হার নিম্নগামী হলেই যে পরবর্তী মাসগুলিতেও সেই প্রবণতাই বজায় থাকবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। বিশেষত, খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে দাম চড়ে যাওয়ার প্রবণতা তীব্র। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আইনি দায়িত্ব হল দেশে মূল্যস্ফীতির হারকে সন্তোষজনক হারে ধরে রাখা। শিল্পে উৎসাহ প্রদান বা আর্থিক বৃদ্ধির গতিবেগ বাড়ানোর মতো বিষয়কে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য থেকে ব্যাঙ্ক বিচ্যুত হলে তা শেষ অবধি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)