সবাই এড়িয়ে যেতে চায়, এমন একটা বিষয়ে কথাবার্তা শুরু করার তাগিদে সুইৎজ়ারল্যান্ডে শুরু হয়েছিল ‘ডেথ ক্যাফে’। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এ বছর একুশে পা দিল মৃত্যু নিয়ে আড্ডার এই ধারা। নাম ‘ক্যাফে’ হলেও এটি কোনও নির্দিষ্ট দোকান-রেস্তরাঁ নয়, এ হল ঘণ্টা দুয়েকের এক জমায়েত। সেখানে সকলে খোলাখুলি আলোচনা করবেন মৃত্যুর কথা। সে আলোচনা হতে পারে নিজের মৃত্যু সম্পর্কে ভয়, দুশ্চিন্তা নিয়ে। হতে পারে কোনও প্রিয়জনের মৃত্যুর শোক নিয়ে অথবা প্রিয়তম মানুষটিকে অসুস্থ বা জরাগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে দেখার দুঃসহ বেদনা নিয়েও। কখনও কোনও ক্যাফে বা রেস্তরাঁয়, কখনও কারও বাড়িতে, যে কোনও জায়গায় এমন কথাবার্তা চলতে পারে, সঙ্গে থাকে চা, কফি, হালকা খাবার। এমন একটা পরিসরের প্রয়োজন যে কতখানি, তা কে না অনুভব করেছেন? জীবন যতই দীর্ঘ হোক, তার শেষে অপেক্ষা করছে মৃত্যু, এই সত্যটি ভুলে থাকায় মানুষের কুশলতা যুধিষ্ঠিরকে আশ্চর্য করেছিল। মৃত্যুকে যে নিয়ত প্রত্যক্ষ, শুধু তা-ই নয়, নিজের শরীরেও ক্ষয় অনুভব করা যায়। ভারতীয় দর্শন বলে, জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় মৃত্যুর প্রক্রিয়া— যা শীর্ণ হয়, তা-ই তো ‘শরীর’। তা সত্ত্বেও প্রায় সব দেশে, সব সংস্কৃতিতে, মৃত্যুর উল্লেখ এড়িয়ে যাওয়াই দস্তুর। অতি-বৃদ্ধ, অতি-অশক্ত পিতামাতার দুরারোগ্য ব্যাধি দেখা দিলেও সন্তানরা তাঁকে আশ্বাস দিয়ে যান, তিনি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে। রোগীর অনিচ্ছাতেও নানা চিকিৎসা চলে। তাঁর মৃত্যুর কথাটি কেউ মুখে আনতে চান না। তা যেন অমানবিকতা, অসভ্যতা।
কিন্তু আসন্ন-মৃত্যু মানুষটির অবস্থা কী হয়? লিয়ো টলস্টয় তাঁর দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচ নামে একটি নভেলায় তার একটা আভাস দিয়েছেন। হোমরা-চোমরা ম্যাজিস্ট্রেট ইভান ইলিচের যন্ত্রণাময় রোগের কারণ নামীদামি ডাক্তাররা ধরতে পারেন না, কিন্তু সকলেই আশ্বাস দিয়ে যান যে ইভান সেরে উঠবে। তার ক্রম-অবনতি, তার মৃত্যুর অনিবার্যতা বুঝেও কেউ উচ্চারণমাত্র করতে চায় না। এই মিথ্যা, এই প্রতারণাই ইভানের কাছে সব চাইতে দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। যদিও তার দাড়িতে পাক ধরেছে, তবু সে প্রাণপণে চাইছিল সবাই যেন তাকে শিশুর মতো করুণা করে। চিকিৎসকেরা অবশ্য এখন বিশ্বাস করেন যে দুরারোগ্য কোনও অসুখে আক্রান্ত হয়ে থাকলে রোগীকে তা জানাতে হবে, তাঁর ইচ্ছা অনুসারে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করে অবশিষ্ট দিনগুলি নিজের মতো করে কাটানোর সিদ্ধান্তও নিতে পারেন রোগী, সেই অধিকার তাঁর রয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি চিকিৎসকেরা সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন রোগীদের সামনে? চিকিৎসক অতুল গওয়ান্ডে নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, অস্ত্রোপচারের ঝুঁকিগুলি বিশদে ব্যাখ্যা করা হয় বটে, কিন্তু তা সফল হলেও রোগী যে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না, তা কেবল মৃত্যুকে সামান্য বিলম্বিত করা হবে, সে কথা বোঝানো হয় না। চিকিৎসকের ক্ষমতার সীমা আছে, চিকিৎসক তা সহজে স্বীকার করতে চান না। মৃত্যুকে স্বীকৃতি দেওয়া, আসন্ন-মৃত্যু রোগীকে পথ দেখানো, সান্ত্বনা দেওয়ার প্রকরণ শেখানো হয় না মেডিক্যাল শিক্ষায়, লিখেছেন গওয়ান্ডে তাঁর বিয়িং মর্টাল বইটিতে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরোগ্য-নিকেতন উপন্যাসের চিকিৎসক জীবন মশায়ের সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসক প্রদ্যোতের সংঘাত বেধেছিল এই কারণেই। প্রদ্যোতের কাছে মৃত্যু চিকিৎসকের প্রতিপক্ষ, জীবন মশায়ের কাছে তা স্বাভাবিক পরিণতি, এমনকি প্রার্থনীয়। জীবন মশায় নিজের দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের আগের দিন প্রদ্যোৎকে বলছেন, “ডাক্তারবাবু, এইবার সে বকুলতলা থেকে বিশ্রাম সেরে উঠে দাঁড়াল।” সজ্ঞানে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে চান মশায়— “তার স্বর থাকলে সে কণ্ঠস্বর শুনবেন, তার গন্ধ থাকলে শেষ নিঃশ্বাসে গ্রহণ করবেন, তার স্পর্শ থাকলে সে স্পর্শ তিনি অনুভব করবেন।” ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য ঠিক এমন ভাবেই আশ্বাস জোগায়। কখনও অমৃতের পথ দেখিয়ে, কখনও আবার মরণকে মধুময় করে তুলে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে যেমন সর্বজয়ার কাছে মৃত্যু আসে শিশু অপুর রূপ ধরে। অচেনা মৃত্যুকে স্বাগত জানাতে, অজানা পথের যাত্রীকে বিদায় জানাতে যারা তৈরি হয়েছে, তাদের বাকি জীবন আরও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, এই প্রত্যয় থেকেই ‘ডেথ ক্যাফে’-র মতো উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু কতটুকুই বা তার প্রসার? নীরবতা দিয়ে মৃত্যুকে অস্বীকার করার কাপুরুষতা সহজে ঘোচার নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)