সমস্যা কাটছে না ভারতীয় অর্থব্যবস্থার। এ বছর জুনে দেশে শিল্পোৎপাদনের সূচক গত বছরের জুন মাসের তুলনায় বেড়েছে ১.৫%। দশ মাসে এই বৃদ্ধির হারই সর্বনিম্ন। এ বছর মে মাসে সূচকের বৃদ্ধির হার ছিল ১.৯%; আর গত বছর জুন মাসে সূচকের বৃদ্ধি হয়েছিল ৪.৯%। লক্ষণীয়, বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) মন্থর ছিল শিল্পবৃদ্ধির হার (২ শতাংশ)। গত বছর এই সময়ে যা ছিল ৫.৪ শতাংশে। তা ছাড়া, দেশের আটটি প্রধান পরিকাঠামো ক্ষেত্রের সিংহভাগেরই উৎপাদন কমেছে। শিল্পোৎপাদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মূলত খনন এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের উৎপাদন হ্রাসই শিল্পের সার্বিক হারকে টেনে নামিয়েছে, যার অন্যতম কারণ অতি বৃষ্টিপাত। বস্তুত, জুনের দ্বিতীয়ার্ধে বর্ষা দ্রুত শুরু হওয়ার ফলেই পণ্ড হয় খনন এবং কলকারখানার উৎপাদনের কাজ। তা ছাড়া, গত জুনে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট (যে সুদে শীর্ষ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ দেয়) কমালেও, বাজারে চাহিদা তেমন বাড়েনি।
তবে শিল্পোৎপাদনের সূচকের বৃদ্ধি হ্রাসের মাঝে আরও উদ্বেগজনক হল, কনজ়িউমার নন-ডিউরেব্লস অর্থাৎ নিত্য ব্যবহারের ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন সঙ্কুচিত হয়েছে। এই পরিসংখ্যানটিকেই যদি দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারের চাহিদার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে দেখা যাবে যে, শহরাঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরে চাহিদা বাড়ছে না। কৃষি বাদ দিলে দেশে কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ জড়িত এই ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে। তার বৃদ্ধি শ্লথ, ফলে কর্মসংস্থান ও বেতন বৃদ্ধির হারও শ্লথ। স্বাভাবিক অনুমান, এর ফলে দেশের এক বড় অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বৈষম্যও। ফলে, সার্বিক ভাবে দেশের অর্থনীতি যে ঝিমিয়ে পড়ছে, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। অন্য দিকে, বিশ্ব অর্থনীতির ঢিমে গতি, বিশেষত আমেরিকার সঙ্কুচিত অর্থনীতির প্রভাব এ দেশের রফতানির চাহিদাকে প্রভাবিত করার আশঙ্কাই প্রবল। তা ছাড়া, আমেরিকার শুল্কনীতির জেরে অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ঝুঁকি বাড়াচ্ছে দেশীয় বাণিজ্যে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আহত হওয়ার আশঙ্কায় শ্লথ লগ্নি কমিয়ে দিতে পারে আর্থিক বৃদ্ধির হারকে।
ফলে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা প্রশমিত করতে সরকারকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ ভোগ-চাহিদা পুনরুজ্জীবিত করার দিকে মন দিতে হবে, বিশেষত শহরাঞ্চলে। সেই চাহিদা বৃদ্ধির প্রথম ও প্রধান পথ কর্মসংস্থানের দিকে জোর দেওয়া, প্রকৃত আয়বৃদ্ধি নিশ্চিত করা। বর্তমান শাসকদের আমলে কর্মসংস্থানের রেকর্ড আদৌ উল্লেখযোগ্য নয়। একই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ পুনরুজ্জীবিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যার জন্য প্রয়োজন অনুকূল বিনিয়োগের পরিবেশ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) জন্য ঋণ প্রদানের নিয়ম সহজ করার ফলে উদ্যোক্তা কার্যকলাপ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিও উৎসাহিত হতে পারে। অন্য দিকে, পরিকাঠামো প্রকল্পেও সরকারি ব্যয় ত্বরান্বিত করা দরকার। পরিবহণ, জ্বালানি এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে কর্মসংস্থান হতে পারে, বাড়তে পারে চাহিদা। বস্তুত, বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি বজায় রাখার ক্ষমতা নির্ভর করছে, ভারত তার অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতাগুলি কত ভাল ভাবে পরিচালনা করতে পারে, তার উপরে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)