E-Paper

দ্বন্দ্ব ও সন্ধি

গহলৌত ও পাইলট উদাহরণমাত্র। তাঁদের মতো নেতাদের ভাবতে হবে, রাজনীতির কাছে তাঁরা কী প্রত্যাশা করেন— নিতান্তই ব্যক্তিগত ক্ষমতা, আধিপত্য, না কি মতাদর্শগত জয়?

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২৩ ০৫:৩৭
An image of Congress Flag

—প্রতীকী চিত্র।

সামনে রাস্তা দু’টি। প্রথমটি রাজস্থান মডেল, দ্বিতীয়টি কর্নাটক মডেল। বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের যুযুধান গোষ্ঠীপতিরা কোন পথ বাছেন— বা বলা ভাল, হাই কম্যান্ড তাঁদের কোন পথটি বাছতে বাধ্য করে— তার উপরে নির্ভর করছে, বহু দিন পরে পাওয়া নির্বাচনী সাফল্যের স্বাদের আয়ু কংগ্রেসে আর কত দিন। রাজস্থান মডেলটি কংগ্রেস রাজনীতিতে পরিচিত: এক দিকে প্রবীণ, পোড়খাওয়া নেতা, দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন যাঁর দিকে; অন্য দিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ নেতা, বিভিন্ন কারণে সেই প্রবীণের নেতৃত্ব মানতে নারাজ। রাজস্থানে প্রথম নেতার নাম মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত, দ্বিতীয় জন সচিন পাইলট। রাজ্য রাজনীতিতে তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরেই পরস্পরের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতে ব্যস্ত— মে মাসের গোড়ায় পাইলট নিজের দলের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলেন! কর্নাটক মডেলটি কংগ্রেসে সুলভ নয়— সেখানে সিদ্দারামাইয়া ও ডি কে শিবকুমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা বিদ্বেষ সরিয়ে গোটা নির্বাচনে লড়লেন একত্রে, মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নটিও ফয়সালা হল ‘বিনা রক্তক্ষয়ে’। ভারতে কংগ্রেসের অস্তিত্ব যত দিনের, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা দুই নেতার মধ্যে অহং-সংঘাতের ইতিহাসও প্রায় তত দিনের। আগে এ-হেন সংঘাতের ফয়সালা হত দল ভেঙে নতুন দল গঠন করে, এখন হয় মূলত বিজেপিতে যোগদানের মাধ্যমে— উদাহরণ, মাধবরাও সিন্ধিয়া দল ভেঙে তৈরি করেছিলেন মধ্যপ্রদেশ বিকাশ কংগ্রেস (যা পরে ফের কংগ্রেসে মিশে যায়); তস্য পুত্র জ্যোতিরাদিত্য সরাসরি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু, বিচ্ছেদের দুই ধরনেই ক্ষতি কংগ্রেসের। পশ্চিমবঙ্গের মতো একাধিক রাজ্যে সে ক্ষতি কার্যত অপূরণীয়। অতএব, দলের যুযুধান গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে কর্নাটক মডেলে সন্ধি স্থাপন না করা গেলে লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের শক্তিক্ষয় হবে বলেই আশঙ্কা।

গহলৌত ও পাইলট উদাহরণমাত্র। তাঁদের মতো নেতাদের ভাবতে হবে, রাজনীতির কাছে তাঁরা কী প্রত্যাশা করেন— নিতান্তই ব্যক্তিগত ক্ষমতা, আধিপত্য, না কি মতাদর্শগত জয়? কংগ্রেসের রাজনীতিতে তাঁরা যদি আস্থাশীল হন, তা হলে বোঝা সম্ভব যে, গেম থিয়োরির ভাষায়, পারস্পরিক সহযোগিতা ‘জ়িরো সাম গেম’ নয়, ‘পজ়িটিভ সাম গেম’। অর্থাৎ, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হতে পারলে দু’পক্ষেরই লাভ। ভারতীয় রাজনীতি বর্তমানে যে পাঁকে নিমজ্জিত হয়েছে, তাতে মতাদর্শের কথা বড় শূন্যগর্ভ শোনায়— তবুও প্রশ্ন করা যাক, বিদ্বেষের বাজারে ভালবাসার দোকান খোলার উদ্দেশ্যটিকে তাঁরা যদি যথাযথ মনে করেন, তবে কি সেই উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য না দেওয়াই বিধেয় নয়? বিশেষত এই মুহূর্তে, যখন বহু দিন পরে কংগ্রেসকে সত্যিই একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প বলে মনে হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে?

হাই কম্যান্ডের ভূমিকাও তাৎপর্যপূর্ণ। কংগ্রেস রাজনীতি চিরকালই দিল্লিমুখী, বিক্ষুব্ধ প্রাদেশিক নেতাদের মনোবেদনার একটি বড় কারণ, হাই কম্যান্ডের কাছে তাঁদের দাবি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। প্রাদেশিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে জিইয়ে রেখে নিয়ন্ত্রণের যে অভ্যাসের উত্তরাধিকার কংগ্রেস ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকে বহন করছে, সেটি এই বার বর্জন করা বিধেয়। প্রায় সব বিবাদের ক্ষেত্রেই সমাধানসূত্র পাওয়া সম্ভব, প্রায় সব চরম অবস্থানেরই মধ্যপন্থা থাকে। হাই কম্যান্ডের কাজ সেই মধ্যপন্থার সন্ধান করা, যুযুধান নেতাদের সেই সূত্রে পৌঁছে দেওয়া। গত কয়েক বছরে দলের যে শক্তিক্ষয় হয়েছে— কপিল সিব্বল থেকে গুলাম নবি আজ়াদ, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ থেকে জিতিন প্রসাদ— কোনও ক্ষেত্রেই দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিক্ষুব্ধ নেতাদের ক্ষোভের উপশম করতে পারেননি। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে দলের স্বার্থ দেখা, এবং অন্যদেরও তা দেখতে সাহায্য করার কাজটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেই করতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Congress Internal Conflict Ashok Gehlot Sachin Pilot

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy