তামিলনাড়ুর এক শিক্ষিকা তৃতীয় সন্তানের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন করলে তার মঞ্জুরি আসেনি। কারণ, ওই রাজ্যের সরকারি কর্মচারীরা দুইয়ের অধিক সন্তানের জন্য এই ছুটি পান না। মাদ্রাজ় হাই কোর্টেও তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে যায়। স্বস্তি এসেছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, এই ছুটি মহিলাদের মাতৃত্বকালীন অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সন্তানজন্মের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। তাই ছুটি অবশ্যপ্রাপ্য। শ্লাঘার বিষয়, ভারত পৃথিবীর প্রথম কিছু দেশের মধ্যে অন্যতম যেখানে কর্মরত মায়েদের বিশ্রাম ও আর্থিক সুরক্ষায় আইন বলবৎ হয়েছে। ১৯৬১-র মাতৃত্বকালীন সুবিধা আইনে সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মরতাদের ১২ সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি নির্দেশিত। ২০১৭-র সংশোধনে, প্রথম দুই সন্তানের ক্ষেত্রে ছুটি বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ করা হয়েছে। আইনটির আওতার বাইরে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলাদের সংগ্রাম নিয়ে বহু আলোচনাই চলছে, তবে, সংগঠিত ক্ষেত্রেও যে আইনের উচিত প্রয়োগ হচ্ছে না— সে ছবিটিও বারে বারে স্পষ্ট।
যেমন, কিছু রাজ্য তৃতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মীদের ছুটি মঞ্জুর করতে চায় না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যই এই বিধি। কিন্তু, চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ত্বই বলে, ছুটি পেলে মা ও শিশুর মৃত্যুর হার কমে। ফলে ছুটি নাকচ মাতৃদুগ্ধ ও টিকাকরণ থেকে শিশুর বঞ্চনার রাস্তাকেই প্রশস্ত করে। মায়ের সুস্থতা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই, এ ক্ষেত্রে ছুটি না পাওয়া শাস্তির নামান্তর। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রকল্প, প্রচারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করা যায় পর্যন্ত; কিন্তু, সেই ওজরে শিশু ও তার মা-কে সমস্যায় ঠেলে শায়েস্তা করা অন্যায়। সন্তানজন্ম বা তাকে কাছে পাওয়ার বিষয়টি সব সময় মেয়েদের হাতে থাকে না। আলোচ্য শিক্ষিকার এটি দ্বিতীয় বিবাহ, প্রথম বিবাহের সন্তান দু’টি তাঁর হেফাজতে নেই। অন্য নানা কারণে সন্তান হারানোও নতুন শিশুর আকুতির একটি কারণ বলে দেখা গিয়েছে। তা ছাড়া, জনসংখ্যা রুখতে এতখানি রুক্ষতার প্রয়োজন নেই। সমীক্ষায় প্রকাশ, শহরাঞ্চলে বহু মহিলারই এক সন্তান, বন্ধ্যাত্বের সমস্যাও প্রকট।
শীর্ষ আদালতের বিবেচনা ন্যায্য— শরীরের উপর নারীর অধিকারকে মান্যতা দিয়েই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নীতি নির্ধারিত হোক। তাঁদের এই উদারভাবনাটুকুই পাথেয়। যে উদ্দেশ্যে আইন, সেই চিন্তাটিকেই বুঝতে হবে। শিশুকে মাতৃদুগ্ধ, মায়ের পরিচর্যা, নারীকে সুস্থতার সময়টুকু দেওয়াই এই মাতৃত্বকালীন সুবিধার মূল উদ্দেশ্য। সেটিই আড়ালে চলে যায় যখন বিভিন্ন ক্ষেত্র শব্দের মারপ্যাঁচকে ঢাল করে এই ছুটিতে আপত্তি তোলে। কোথাও নতুন জায়গায় বদলি হলে মাতৃত্বের ছুটি মিলছে না, কোথাও মাতৃত্বের ছুটিকে চাকরির মোট সময়ের হিসাব থেকে বাদ ধরায় কর্মজীবনে অসুবিধা হচ্ছে, এমনকি একক অভিভাবক হওয়া সত্ত্বেও জেলা জজকে পর্যন্ত সন্তানলালনের ছুটি দেওয়া হচ্ছে না। এমনই সব মামলার ভিড় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে। মাতৃত্বকালীন ছুটিতে সংস্থাগুলির অনীহার একটি কারণ আর্থিক চাপ, প্রয়োজনে সরকারের তরফে তার কিছুটা ভাগ নিলে হয়তো মেয়েদেরই কষ্ট কমবে। এবং, সরাসরি তাদের উল্লেখ না থাকলেও আইন অনুসরণেই সরকারি সংস্থাগুলির নীতি সাজানো উচিত। পরিষেবাটিকে মানবমুখী করতে নজরদারি প্রয়োজন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)