Advertisement
E-Paper

সংশোধনী

শুধু মেয়েদের কাছেই প্রচার করলে চলবে না, পুরুষদেরও জানাতে হবে যে, পঞ্চায়েতে মেয়েদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার সংরক্ষণ নেহাত পুতুল খেলা নয়, উন্নয়নের স্বার্থে এই উপস্থিতি নির্বিকল্প।

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ০৪:৫৫
Share
Save

পঞ্চায়েতের প্রধান পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন মঞ্জু দেবী, কিন্তু ‘প্রধানজি’ সম্বোধনটি বরাদ্দ ছিল তাঁর স্বামীর জন্যই। পঞ্চায়েতের বৈঠক থেকে স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন, সবই ছিল প্রধান-পতির দায়িত্ব। উত্তরপ্রদেশের কাল্পনিক ফুলেরা গ্রাম পঞ্চায়েতের এই ওটিটি সিরিজ়-কাহিনিকে ‘কাল্পনিক’ বলার কোনও উপায় নেই। প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে সংবিধানে ৭৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে স্থানীয় স্বশাসন ব্যবস্থায় এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত হয়েছিল মহিলাদের জন্য। দেশের ২১টি রাজ্য এবং দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আরও এক ধাপ এগিয়ে মহিলাদের জন্য অর্ধেক আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। তবু, বহু ক্ষেত্রেই সেই মহিলাদের হয়ে দায়িত্ব সামলান তাঁদের পরিবারের পুরুষরা— দেশের সর্বত্রই। এই সমস্যার সমাধানে গঠিত কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রকের প্যানেল দ্বিমুখী সমাধানসূত্র দিল— এক দিকে সমাজে, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে, সচেতনতার প্রসার ঘটাতে হবে; অন্য দিকে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় পথটি গোলমেলে— যেখানে নজরদারির পরিকাঠামো অপ্রতুল, এবং বিবিধ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে শাস্তিবিধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ, সেখানে শাস্তির হুমকি গোটা ব্যবস্থাটিকে অপরিবর্তিত রেখে কেবলমাত্র আড়ালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। তা ছাড়াও আশঙ্কা হয় যে, শাস্তির অস্ত্রটি ব্যবহৃত হবে মূলত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে, অথবা বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে। তার বদলে সচেতনতা প্রসারের কাজটিতে মনোনিবেশ করা ভাল।

‘প্রধান-পতি’ নামক সংস্কৃতিটি আসলে সমাজের পরিসরে রাষ্ট্রের কার্যকারিতার সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে তোলে। সমাজের অভ্যন্তরে নারীকে খাটো করে দেখার পুরুষতন্ত্র-সঞ্জাত মানসিকতা ‘আধুনিক’ ‘প্রগতিশীল’ রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্র তার সংশোধন চায়, কিন্তু সহজতম পন্থায়। সেই পথটি হল আইন প্রণয়নের— সংসদের পরিসরে বিতর্কে জয়ী হয়ে সরকার আইন বেঁধে দেয় যে, মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েতে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষণ করতে হবে; এবং সেই রাজনৈতিক ক্ষমতাই তাঁদের সার্বিক ক্ষমতায়নের পথে নিয়ে যাবে বলে রাষ্ট্র বিশ্বাস করে, অথবা তা বিশ্বাস করে বলে জানাতে চায়। অন্য দিকে, রাষ্ট্রের হাত কত দূর পৌঁছতে পারে, সে কথা সমাজও জানে। অতএব, খাতায়-কলমে সংরক্ষণ হয়, মহিলারা ভোটে দাঁড়ান এবং জেতেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাটি থেকে যায় পুরুষের হাতেই। রাষ্ট্রের আধুনিক সদিচ্ছা সমাজের ব্যূহ ভেদ করে ঢুকতে পারে না।

লড়াইটি, অতএব, পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর বিরুদ্ধে— পরিবারের ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধেও। ভারতে রাষ্ট্র যাঁরা চালান, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ চিরকালই সেই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ধারক ও বাহক। অতএব, কাঠামোটি অক্ষুণ্ণ রেখে আইনি বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে অথবা শাস্তির হুমকি দিয়ে রাষ্ট্র দায় সারে। সত্যিই যদি ৭৩তম সংবিধান সংশোধনীকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হয়, তবে কেবলমাত্র পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের উপস্থিতির গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতনতার প্রসারই যথেষ্ট নয়— পরিবারের, সমাজের প্রতিটি পরিসরে নিহিত বৈষম্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। শুধু মেয়েদের কাছেই প্রচার করলে চলবে না, পুরুষদেরও জানাতে হবে যে, পঞ্চায়েতে মেয়েদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার সংরক্ষণ নেহাত পুতুল খেলা নয়, উন্নয়নের স্বার্থে এই উপস্থিতি নির্বিকল্প। আদর্শ সমাজে সংরক্ষণের প্রয়োজন হত না, স্বাভাবিক নিয়মেই অর্ধেক জনপ্রতিনিধি মহিলা হতেন। পুরুষতন্ত্রের ইতিহাস সেই অবকাশ রাখেনি। অতএব, এই সংরক্ষণকে একটি ঐতিহাসিক অন্যায়ের সংশোধনের রাষ্ট্রীয় প্রয়াস হিসাবে দেখা জরুরি। প্রকৃত দায়িত্বের অধিকারী হলে মেয়েরা যে তাতে ব্যর্থ হন না, সেই প্রমাণগুলিও সমাজের সামনে উপস্থিত করতে হবে। প্রশ্ন হল, এই গুরুদায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র প্রস্তুত কি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Womens day special Politics Panchayat pradhan Constitution Patriarchal Society

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}