অস্বীকারের উপায় নেই, পশ্চিমবঙ্গ এমন এক রাজ্য যেখানে নির্বাচনের দিনে ভোটকেন্দ্রগুলি কার্যত রণক্ষেত্রে পর্যবসিত হয়। ভোট চলাকালীন বোমা বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ, রক্তপাত, ছুরিকাঘাত এমনকি মৃতদেহের মিছিল দেখতে অভ্যস্ত রাজ্যবাসী। অভিজ্ঞ সরকারি চাকরিজীবী পর্যন্ত মানেন, বাহিনী থাকা সত্ত্বেও ভোটের ডিউটিতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। এ-হেন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতেই আসন্ন কালীগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে অনূর্ধ্ব ১৮-র স্কুলপড়ুয়াদের ভোটবুথে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করাতে চলেছে নদিয়া জেলা প্রশাসন। যে শিক্ষার্থীরা এনসিসি-তে নথিবদ্ধ, তারা বুথের বাইরে ভোটারদের থেকে মুঠোফোন জমা নেওয়ার কাজ করবে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনামা অনুসারে জারি করা এই বিজ্ঞপ্তিতে যুযুধান দুই রাজনৈতিক শিবিরের নেতারা পর্যন্ত বিস্মিত। ওই নির্দেশনামা অনুযায়ী এনসিসি ক্যাডেটদের দিয়ে নির্বাচনে ভোটারদের সারণি তত্ত্বাবধান করানো যায়, কিছু রাজ্যে সেই প্রচলন রয়েছে। কিন্তু, রাজনৈতিক সংঘর্ষের জন্য কুখ্যাত এই রাজ্যে এমন চাহিদা দায়িত্বজ্ঞানহীন।
বিবিধ নির্বাচনী নির্ঘণ্টে পড়ুয়াদের অপরিসীম ঝঞ্ঝাটই যেন ভবিতব্য। ভোটে ব্যবহারের জন্য স্কুলবাস তুলে নেওয়া হয়, ছুটি দিয়ে ক্লাসঘর পরিণত হয় বাহিনীর আশ্রয়স্থলে। নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য ও শিক্ষকদের ভোট-ডিউটি দেওয়ায় স্কুল বন্ধ থাকে দিনের পর দিন। প্রতিষ্ঠান খুললেও দেখা যায় নির্বাচনী হিংসায় স্কুলবাড়ি ও আসবাবের ক্ষতি হয়েছে। সব দিক খতিয়ে দেখে পুরো শিক্ষাক্ষেত্রকেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার আওতার বাইরে রাখার দাবি উঠেছে বহু বার। কিন্তু, অবজ্ঞাই সরকারের ভূষণ। জগদ্দল ধারণা, সরকারি স্কুল মানেই সরকারের সম্পত্তি। কর্তৃপক্ষের স্মরণ রাখা জরুরি, বিদ্যালয়গুলি তাঁদের অধীন কর্মক্ষেত্র মাত্র নয়, তা সামাজিক সম্পদ। তার স্বাতন্ত্র্যে হস্তক্ষেপ করলে জাতির ভবিষ্যতে বাধা দেওয়া হয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির যথেচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবহার নয়, সরকারের কাজ তার সুষ্ঠু চালনা নিশ্চিত রাখা ও পড়ুয়াদের শিক্ষার ধারায় যুক্ত রাখার চেষ্টা করা। নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালাতে মৌলিক অধিকারকে ব্যাহত করা কেন?
এনসিসি-র কার্যাবলিতেও সরাসরি শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার বিষয়টি নেই। এনসিসি-র মূল লক্ষ্য চরিত্রগঠন, নেতৃত্বদান, অনুশাসন শেখানো, শৃঙ্খলাপরায়ণ করে তোলা। আপৎকালে সমাজসেবায়, আর্তত্রাণে যোগদানে তারা থাকুক, এটাই কাম্য। কিন্তু বাৎসরিক ভোট-মচ্ছবে এর একটিও অনুশীলনের অবকাশ নেই। আরও প্রশ্ন, যে অপ্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারই নেই, তাকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার আগে অভিভাবক, স্কুলের মতামতই বা নেওয়া হবে না কেন? যুক্তির ঢাল দেখানো হয় যে, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আগ্রহী করতে, ভবিষ্যতের নাগরিকদের ছাত্রবয়স থেকে পরোক্ষ ভাবে এই প্রক্রিয়ায় শামিল করা হয়। কিন্তু তার জন্য অন্য পথও ছিল। ‘জাতীয় ভোটার দিবস’-এ স্কুলে বিশেষ কার্যক্রম, গণতন্ত্র বিষয়ে রচনা লিখতে উৎসাহ দান, শ্রেণিকক্ষে যুব সংসদের আয়োজন করে স্বাস্থ্যকর বিতর্কে ছোটদের যুক্ত করা যেতে পারে। তা ছাড়া, দুর্ভাগ্যক্রমে, নির্বাচনী রাজনীতির অঙ্গনটি যথেষ্ট বিপজ্জনকও বটে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের সুরক্ষা ও অধিকারের খাতিরেই সিদ্ধান্তটি অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)