কত মৃত্যুর পরে প্রশাসন শেষ পর্যন্ত নড়ে বসবে, কলকাতাবাসী এ প্রশ্নটির উত্তর কার কাছে প্রত্যাশা করবেন? বড়বাজারের হোটেলে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ১৪। ভয়ঙ্কর ঘটনা, কিন্তু শহরবাসী বোধ হয় এতে আর বিস্মিত হবেন না। শহরে আগুন লেগেছে বারে বারেই— হোটেল-রেস্তরাঁ-পানশালায়, কারখানায়, গুদামে, দোকানে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরই জানা গিয়েছে, বিপুল অনিয়ম ছিল। যেমন, বড়বাজারের হোটেলটিতে ঢোকা-বেরোনোর রাস্তা ছিল একটিই। বিকল্প আপৎকালীন রাস্তা থাকলে আগুন লাগার পরে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারতেন অনেকেই। জানা গিয়েছে, হোটেলে থাকা অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রের অধিকাংশই অচল ছিল। কাজ করেনি হোটেলের ঘরে থাকা স্প্রিঙ্কলারও। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন যে, হোটেলে দাহ্য পদার্থ মজুত করা ছিল। জানা গিয়েছে, সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত ভাবে তৈরি হচ্ছিল ডান্স বারও। অর্থাৎ, যত রকমের অনিয়ম সম্ভব, বড়বাজারের হোটেলটিতে তার প্রায় সবই ঘটছিল। এতগুলি প্রাণহানির আগে সেই অনিয়ম ধরা সম্ভব হল না কেন? তার কারণ, দীর্ঘ দিন ধরে ফায়ার অডিট হয়নি বলেই জানা গিয়েছে। অর্থাৎ, অগ্নি-নির্বাপণের মতো অতি জরুরি বিষয়ে কী গাফিলতি হচ্ছে, প্রশাসন সে খোঁজ রাখেনি। এক একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে, এবং তার পর প্রতি বারই পুরসভা কঠোর হওয়ার হুমকি দেয়; দমকল দফতর জানায় যে, কোনও অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না। পরের আগুনটি লাগলে বোঝা যায়, ওগুলো নেহাত কথার কথা ছিল। আশা করা যায়, এ বারও কর্তারা ভবিষ্যতে কঠোর হওয়ার বাণী শোনাবেন। তাতে কাজের কাজ যে কিছুই হবে না, শহরবাসী তা জানেন।
গোটা শহরটিই কার্যত বারণাবত হয়ে আছে। কোথাও বিপজ্জনক ভাবে ইলেকট্রিকের তার ঝুলে থাকে, কোথাও বসতি এলাকায় বেপরোয়া চলে বিপজ্জনক রাসায়নিকের কারখানা। কোথাও দাহ্য পদার্থের স্তূপ জমে থাকে, কোথাও গ্যাস সিলিন্ডার রাখা থাকে অযত্নে। আগুন লাগলে তা নির্বাপণের ব্যবস্থা কী, সে প্রশ্নের উত্তরে সাদা খাতা জমা পড়ে। আপৎকালীন নিষ্ক্রমণের পথ নেই, ফায়ার অ্যালার্ম নেই, এমনকি সামান্য অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রও নেই প্রায় কোথাও। নিয়ম রক্ষার্থে কোনও কালে যদি এই যন্ত্রপাতি কেনা হয়ও, অযত্নে অবহেলায় সেগুলি অচল হয়ে থাকে। শহরবাসী অভিজ্ঞতায় জানেন, এই অবস্থাটিই কলকাতা শহরে নিয়ম। প্রাণ হাতে করে দিন কাটানো কালক্রমে এমনই অভ্যাস হয়ে যায় যে, এই অনিয়মগুলি আর মানুষের চোখেও পড়ে না। দুর্ঘটনা ঘটলে সে প্রসঙ্গে কথা হয়, কয়েক দিনের তৎপরতা চলে, তার পর যথা পূর্বং। কলকাতা দাঁড়িয়ে থাকে আগ্নেয়গিরির উপরে।
কেউ বলতে পারেন, এমন হোটেল-গুদাম-বাড়ি-কারখানার যাঁরা মালিক, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা তাঁদেরই কর্তব্য। অবশ্যই। কিন্তু, যে কোনও সভ্য শহরে কেউ নিয়ম মানতে অস্বীকার করলে তাকে বাধ্য করার কাজটি প্রশাসনের। তার জন্য নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন; নিয়মভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নিয়মিত ফায়ার অডিট হলে এই অনিয়ম চলতে পারে না। পুরসভা বা দমকলের তরফে তেমন তৎপরতা চোখে পড়ে না। তার কারণ, বারংবার দুর্ঘটনা ঘটার পরও পুরসভা বা দমকলের কোনও দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের শাস্তি হয় না। কর্তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে, দায়িত্ব গ্রহণের সু-অভ্যাস তাঁদের গড়েই ওঠেনি। দুর্জনে অভিযোগ করবে, এই ফাঁক গলেই এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে জাঁকিয়ে বসেছে মনসবদারি ব্যবস্থা— কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে আধিকারিকরা যে কোনও অনিয়মের ছাড়পত্র দিয়ে চলেছেন। দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও বেনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়ার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গকে বিপর্যস্ত করেছে, ঠিক সেই সংস্কৃতিই দায়ী ১৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য। দায় স্বীকার করবেন কে? সংশোধনের দায়িত্বই বা গ্রহণ করবেন কে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)