কলকাতায় রিজেন্ট পার্ক থানা এলাকায় যে প্রৌঢ় মানুষটি গত সপ্তাহে আত্মহনন বেছে নিলেন, ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ বা এসআইআর-এর আবহে তিনি ভীত, সন্ত্রস্ত ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষটি পশ্চিমবঙ্গে এসে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন, জীবন-জীবিকা-সংসার গুছিয়ে তুলেছিলেন তিল-তিল করে। সত্তর দশকের শুরুতে দুই বাংলার রাজনীতি কোন বিন্দুতে দাঁড়িয়ে ছিল তা এখন আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই— সীমান্তের ও-পারে যুদ্ধের ফলাফল যে উদ্বাস্তুস্রোত, এ-পারের সমাজ সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও তাকে যে জায়গা দিয়েছিল, তার মূলগত কারণটি যুদ্ধ, রাজনীতি, সমভাষার দরদ ইত্যাদি পেরিয়েও— মানবিকতা। রাষ্ট্র ও সমাজ, দুই-ই ছিল এঁদের প্রতি মানবিক, সেই কারণেই সমব্যথী। কিন্তু এই ২০২৫-এ এসে প্রৌঢ় মানুষটিকে রাষ্ট্রের উগ্র অমানবিক মুখটি দেখতে হল, সেই সঙ্গে তাঁর চার পাশের সমাজের অসহিষ্ণুতাও, আর সেই কারণেই তিনি বেছে নিলেন চরম সিদ্ধান্তটি— বললে খুব ভুল হবে?
যে রাষ্ট্র নাগরিক তথা সাধারণ মানুষকে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না, তাকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে, জীবন শেষ করে দেওয়ার পথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্ররোচিত করে, তা আপাদমস্তক অমানবিক। এই অমানবিকতা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি গত কয়েক বছর ধরেই দেখিয়ে চলেছে, ২০১৮-র অসম থেকে ২০২৫-এর বিহার পর্যন্ত তার সাক্ষী। অসমে এনআরসি-র পরিণতি দেশের চোখের সামনে: রাষ্ট্রের ‘বেআইনি অভিবাসী’ নির্মূল অভিযানে অন্তত উনিশ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্ব হারিয়েছেন; ডিটেনশন সেন্টারে গিয়েছেন অগণিত মানুষ। নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘সিটিজ়েনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ দেখিয়েছে, ২০১৮-র জানুয়ারি মাসে এনআরসি-র ‘আপডেটেড’ সংস্করণের প্রথম খসড়া প্রকাশের সময় থেকে পরের বছর জুন অবধি অসমে অন্তত ৫১টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, যার কারণ এনআরসি-ভীতি ছাড়া আর কিছুই নয়— বাড়ি জমি বিষয়সম্পত্তি পরিবার গ্রাম রাজ্য দেশ নাগরিকত্ব এই সব কিছু মিলিয়েই নাগরিকের যে ‘পরিচয়’, তা হারানোর অসহ্য উদ্বেগ ও ভয়।
বিহারে এসআইআর-এর প্রাথমিক কাজ হয়ে গিয়েছে, আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করে এ রাজ্যে এরই মধ্যে ‘অবৈধ ভোটার’ নিয়ে রাজনৈতিক সুর চড়া। বিজেপি নেতারা প্রচার করছেন এ রাজ্যে দু’কোটি ভুয়ো ভোটারের তত্ত্ব। রাজনৈতিক বয়ান এক জিনিস, আর সাধারণ মানুষের মনে তা কোন ছাপ ফেলছে, তা আর এক। কলকাতায় আত্মহননের ঘটনাটিই প্রমাণ, আবারও ফিরে এসেছে কয়েক বছর আগের অসমের ছায়া। অসম বা বিহারের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যে সরকার যে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবেই এনআরসি বা এসআইআর প্রয়োগ করবে তা জানা কথা। কিন্তু কলকাতার ঘটনাটি আরও হৃদয়-বিদারক, কারণ নাগরিকপঞ্জি বা ভোটার তালিকা সংশোধনের ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দৃঢ় সরব রাজনৈতিক অবস্থানও সেই মানুষটির ভয় দূর করতে পারেনি, তাঁর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক শান্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। অথচ তিনি ছিলেন বৈধ পরিচয়ধারী এক নাগরিক— আজকের জনপ্রতিনিধিরা রাজ্য ও রাষ্ট্রীয় স্তরে ‘শাসক’ হয়েছেন যে জনমতের জোরে, তারই ক্ষুদ্র কিন্তু অপরিহার্য অঙ্গ। একে আত্মহত্যা বলা হবে না কি ‘রাজনৈতিক হত্যা’, সেই জরুরি রাজনৈতিক তর্কটি জারি থাক, কিন্তু সবার আগে আঙুল তোলা দরকার সেই রাষ্ট্রের দিকে, যার অমানবিক রুদ্রমূর্তি নাগরিকের ভুলে-থাকা নিরাপত্তার অভাবকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তোলে, করে তুলতে চায় নিজভূমেই পরবাসী। রাষ্ট্র নাগরিককে বিস্তর সুযোগসুবিধা না দিক, অন্তত বাঁচতে দেবে— এইটুকুও আজকের ভারতে সত্য নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)