নির্বাচনী ও সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোয় যত অসঙ্গতিই থাক, তবু তাকে আশ্রয় করেই ক্ষমতাতন্ত্র, শাসক এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়— শীর্ষ মাওবাদী নেতা বাসবরাজুর মৃত্যুর প্রেক্ষিতে এই রাজনৈতিক সত্যই আর এক বার উঠে এল। এনআইএ-র ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা, দেড় কোটি টাকা ‘মাথার দাম’ নিয়ে ছত্তীসগঢ়ে গেরিলা জনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বাসবরাজু ও সেই সঙ্গে আরও ছাব্বিশ জন মাওবাদীর মৃত্যু সাম্প্রতিক কালে মাওবাদ দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর সবচেয়ে বড় সাফল্য। যে কৌশলে এই কাজ সম্ভব হল সেটিও লক্ষ করার: মাওবাদ নির্মূল করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘জাতীয় পরিকল্পনা’ সাম্প্রতিক কালে ধারেভারে বেড়েছে; ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, এক-একটি রাজ্য ধরে ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রস্তুতি ও ‘অপারেশন’-এর ধাঁচও পাল্টেছে। এই কাজ সহজ করে তুলেছে আধুনিক প্রযুক্তি, সেই সঙ্গে মাওবাদ-প্রভাবিত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর ‘জনসংযোগ’ স্থাপন ও মেরামতের উদ্যোগও। বাসবরাজুর ক্ষেত্রে যেমন প্রাক্তন মাওবাদী তথা বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীদের সহযোগিতা বিশেষ কাজে দিয়েছে।
মাওবাদী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দূরত্ব যে বাড়ছিল, তার ইঙ্গিত ছিলই। প্রথমত, একদা মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রামের অঙ্গ ছিল অরণ্যসঙ্কুল অনুন্নত অঞ্চলগুলিতে দরিদ্র, ভূমিহীন, দলিত মানুষের অধিকারের পক্ষে তাঁদের লড়াই। সাধারণ মানুষ যে মাওবাদীদের সাহায্য করতেন তা যেমন এক দিকে ভীত সন্ত্রস্ত বা অনন্যোপায় হয়ে, তেমনই এক রকম সহানুভূতির অনুভব থেকেও। যে মনোযোগ ও দরদ রাষ্ট্র দেখায়নি বা দেখাতে সফল হয়নি, সেই ‘ফাঁক’ থেকে। তবে সাম্প্রতিক কালে মাওবাদীদের সম্পর্কেও ধারণা পাল্টেছে। রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ইত্যাদি নানা উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ করে রাষ্ট্র যতখানি এগিয়ে এসেছে, হিংসা আদর্শে বিশ্বাসী বিপ্লবীরা কিন্তু সে ভাবে আসেননি। দ্বিতীয়ত, মাওবাদী স্কোয়াড-সদস্যদের আত্মসমর্পণ ও রাষ্ট্রীয় পুনর্বাসনের ‘সুবিধা’ও একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। সরকারি ভূমিকায় এসে অনেক প্রাক্তন বিদ্রোহী দমন-অভিযানের কাজে বিশেষ সহায়ক হয়েছেন। তৃতীয়ত, গত কয়েক দশকে মাওবাদী ও সরকারের রক্তক্ষয়ী দ্বৈরথে প্রাণ গিয়েছে অগণিত সাধারণ মানুষের, বিশেষত জনজাতি গোষ্ঠীর তরুণদের। মাওবাদী জনযুদ্ধের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তাদের মনে ঘনীভূত হয়েছে সংশয়, বিরাগ। একদা যারা ছিল মাওবাদীদের জনবল ও মনোবলের চালিকাশক্তি, তারাই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থটি স্পষ্ট: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ ভাবে এই পথে ‘যুদ্ধ’কে তাদের প্রত্যাখ্যান। একুশ শতকে মাওবাদী রাজনীতির দর্শনের পরাজয় আছে এই সংঘর্ষ-চিত্রের মধ্যে, বললে ভুল হবে না।
এক দিকে ‘উন্নয়ন’ দিয়ে মানুষকে কাছে টানা, অন্য দিকে নিরাপত্তা বাহিনীকে ক্ষুরধার করে তোলা, এই দুই রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের বাইরে আরও একটি চতুর্থ কারণও ভাবা কঠিন নয়। মাওবাদ নিয়ে সমাজে একদা সংবেদনের জায়গাটি আর আগের মতো নেই। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, রাষ্ট্রই সমাজের চোখে সর্বেসর্বা; ভোটের রাজনীতিই শেষ রাজনীতি। এই পরিবর্তিত সমীকরণে মাওবাদীরা ‘বিদেশি’ সন্ত্রাসবাদীর মতোই রাষ্ট্রের ‘শত্রু’ বলে ক্রমে চিহ্নিত হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অভিযানে সমাজ প্রত্যক্ষ সমর্থন না হোক, প্রতিবাদ করেনি। দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রবাদ এই সামাজিক প্রবণতাকে আরও শক্ত করে তুলেছে। এই সামগ্রিক বেসুরটি বুঝে মাওবাদীদের ভিতর থেকেও আলোচনায় বসার কথা উঠে আসছিল, যদিও তাঁরা গেরিলা যুদ্ধও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সুযোগ বুঝে সরকারও আলোচনার ইচ্ছা দেখায়নি। বাসবরাজুর নিধন একটি নতুন মোড়। অতঃপর দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পথ তৈরি হোক, রক্তের পথ আর নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)