জাতীয়তাবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, ঔপনিবেশিকতা, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, সংখ্যাগুরুবাদ, গণতান্ত্রিক অধিকার: এই সমস্ত রকম ধারণার উপর ভিত্তি করে বিতর্ক এসে একটি ক্ষেত্রে জড়ো হয়— যার নাম ভারতের ভাষা নীতি। বাস্তবিক, স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশের ভাষা নীতি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘর্ষের মুক্তমঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সদ্যোজাত দেশের নেতৃত্বে বসে তা ভালমতোই টের পেয়েছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এখনও, একুশ শতকের তৃতীয় দশকের মধ্যভাগে এসেও ভাষাকে কেন্দ্র করে একই সংঘর্ষ ও প্রতিরোধ টের পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকার। দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত বিরোধী দল-শাসিত তামিলনাড়ুতে ত্রিভাষা নীতির নামে হিন্দিকে সমগ্র ভারতের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ‘চক্রান্ত’র বিরুদ্ধে ক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠেছে। তামিল মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন এই ক্ষোভ-আন্দোলনের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে, তাঁর সঙ্গে চলছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সরাসরি দ্বৈরথ। স্ট্যালিন অভিযোগ করেছেন যে, ইতিমধ্যে উত্তর ভারতের অন্তত পঁচিশটি ভাষাকে গিলে খাওয়ার পর হিন্দি এখন কেন্দ্রীয় সরকারি নীতির মাধ্যমে দক্ষিণ ভারত ও অন্যত্র আগ্রাসী রূপ নিচ্ছে। বিপরীতে দাঁড়িয়ে শ্রীযুক্ত অমিত শাহ বার্তা দিয়েছেন যে, এতই যদি তামিল-অস্মিতা, তবে মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো পরীক্ষাও এ বার থেকে তামিল ভাষায় নেওয়ার ব্যবস্থা করে ‘দেখান’ স্ট্যালিন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও শোনা গিয়েছে প্রতিবাদ, বাংলার জায়গায় হিন্দিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিজেপি রাজনীতির বিরুদ্ধে। স্বভাবতই, ইতিহাসের পথ ধরেই আবারও এই সব ক্ষোভে প্রতিবাদে উঠে আসছে বিজেপির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক সত্তার দমন-দলন এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নীতি পরিহারের অভিযোগ।
এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সময়োচিত, জরুরি। উত্তর ভারতে প্রচলিত হিন্দুধর্মের যে বিশেষ ধারাকে সমগ্র দেশে প্রতিষ্ঠা করতে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি বদ্ধপরিকর, সেটি যে হেতু হিন্দিভাষী অঞ্চলের সংস্কৃতি, মোদীর শাসনে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ স্লোগান-অবতার ছাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি-র উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। অথচ, কেবল দক্ষিণে নয়, উত্তর ভারতের বহু আঞ্চলিক ভাষাও হিন্দির সঙ্গে সংযোগবিহীন। তদুপরি, দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলি কেবল উৎসগত ভাবেই হিন্দির থেকে দূরের নয়, তাদের রাজনীতির মধ্যে গত সাড়ে সাত দশক ধরে হিন্দি বলয়-সংস্কৃতির একটি প্রতিস্পর্ধা তৈরি হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস বা বিজেপি ইত্যাদি দলীয় পরিচিতি দিয়ে সেই রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধার বিচার হয় না, বরং আঞ্চলিক অস্মিতার মর্যাদা ও মান্যতা দিয়েই দলীয় রাজনীতির পথ চলার কথা। অথচ ভারতীয় জনতা পার্টি এই সহজ কথাটি বুঝতে নারাজ।
সঙ্কট নতুন করে ঘনীভূত হয়েছে নবপ্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতির কারণে। ভারতীয় সংবিধানে হিন্দিকে বিশেষ মর্যাদা দিলেও ‘জাতীয় ভাষা’ হিসাবে গণ্য করা হয়নি, অথচ ২০২০ সালের নীতিটিতে ত্রিভাষাসূত্রের মধ্যে খিড়কি দুয়ার দিয়ে হিন্দি শিখতে বাধ্য করার চেষ্টা স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় স্তরে গৃহীত পরীক্ষাগুলি যদি ইংরেজি ছাড়া কেবল হিন্দিতে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই ত্রি-নীতির আড়ালে হিন্দির একচ্ছত্র প্রতাপ জারি হয়। ফলে অমিত শাহ যে কথাটা উপহাসচ্ছলে বলেছেন, তার মধ্যে নিখাদ বাস্তবতাই দেখা যেতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোনও ভাবে ইংরেজি ছাড়া আঞ্চলিক ভাষার অন্তর্ভুক্তি সম্ভব কি না, তা ভাবার সময় এসেছে বইকি। সন্দেহ নেই, স্ট্যালিনের ভাষাবিতর্ক উস্কে দেওয়ার মধ্যে আগামী নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক হাওয়া গরম করার চেষ্টা আছে। বিজেপির বিরুদ্ধে সেই প্রচেষ্টায় তাঁর রাজ্যে তিনি কতখানি সফল হবেন, দেখা যাক। তবে এও ঠিক, রাজনীতির উত্তর শেষ পর্যন্ত রাজনীতির মুদ্রাতেই এসে থাকে। কেন্দ্রীয় শাসক বিজেপি নিশ্চয়ই সে কথা ভালমতোই অবহিত।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)