E-Paper

হিংসার জয়গাথা

পরিকল্পিত ভাবে মানুষকে রাগিয়ে দিয়ে তা থেকে আর্থিক লাভ অর্জন— ভেবে দেখলে, আদ্যন্ত অনৈতিক একটি কাজ, কিন্তু চটজলদি মুনাফা অর্জনের লোভ আর কবেই বা নৈতিকতার তোয়াক্কা করেছে!

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:১৫

এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিধান ২০২৫-এর ‘বছরের শব্দ’ হিসাবে বেছে নিয়েছে ‘রেজ বেট’-কে। শব্দটি মূলত অনলাইন মাধ্যমে ব্যবহৃত— অর্থ, দর্শককে রাগিয়ে দিয়ে, উত্তেজিত করে তাঁদের মনোযোগ কাড়বে, এমন কনটেন্ট বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত দৃশ্য-শ্রাব্য উপাদান। মানুষ যত রেগে যায়, ততই সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে থাকে— তাতে এই কনটেন্টে ডিজিটাল ভিড় বাড়ে। উস্কানিমূলক শিরোনাম, আধা-সত্য, কোনও ঘটনার নির্বাচিত অংশ চাউর করে দেওয়া, কোনও ছবির কিছু বিশেষ মুহূর্তকে ছড়িয়ে দেওয়া— সবই এই মুখরোচক প্ররোচক বিষয় রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে অনলাইন বিশ্বে। টোপ হিসাবে রাগকেই নির্বাচন করা হচ্ছে, কারণ রাগ মানুষকে অস্থির করে— তার বহিঃপ্রকাশ হয় হিংসায়, ধ্বংসে, তাণ্ডবে। পরিকল্পিত ভাবে মানুষকে রাগিয়ে দিয়ে তা থেকে আর্থিক লাভ অর্জন— ভেবে দেখলে, আদ্যন্ত অনৈতিক একটি কাজ, কিন্তু চটজলদি মুনাফা অর্জনের লোভ আর কবেই বা নৈতিকতার তোয়াক্কা করেছে!

গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, এই রাগ আর হিংসাকেই পুঁজি করছে বিনোদনশিল্প। ‘দুষ্টের দমন’-মার্কা মারপিটের সিনেমা বরাবরই হত— রাগী তরুণের ‘অ্যাকশন’ দেখে দর্শকের হাততালি আর সিটিতে সিনেমাহল রমরম করত আগেও। কিন্তু, আজকের কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি বা সিজিআই-এর যুগে হিংস্রতা ও নৃশংসতার যে দৃশ্য নির্মাণ করা সম্ভব, অতীতে তা অকল্পনীয় ছিল। ফলে, বাজারে হিংস্রতার চাহিদা এবং বাণিজ্য-সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে বিনোদনশিল্প হিংস্রতার প্রদর্শনকে যে মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে, তা এই বিশ্ব আগে কখনও দেখেনি। সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ়ের সেই বীভৎস দৃশ্য আবার রিল হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমে। আক্ষরিক অর্থেই সেই হিংস্রতা হাতে হাতে ফেরে, ক্রমে ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠতে থাকে। হিংসা আর ক্রোধকে বীরত্ব বলে দেখালে, কারও মৃত্যুর পর হত্যাকারীর নামে জয়ধ্বনি উঠলে, নৈতিকতা আর সভ্যতার সীমারেখাটাই ক্রমে ঝাপসা হয়ে যায়। বাস্তব জীবনেও তখন কারও দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি আসে না সহজে, ভোঁতা হয়ে যায় মানবিক বৃত্তিগুলি। মানুষ শুধু বুঝে নেয় কাউকে মজা দেখানো, শাস্তি দেওয়াটাই বুঝি বহু কাঙ্ক্ষিত সেই ‘ক্ষমতা’। দেশপ্রেমের নামে হিন্দি ছবি যখন বীভৎসার প্রদর্শন করে, আর যখন কোনও গণহত্যা বা ধর্ষণের প্রকৃত দৃশ্য সমাজমাধ্যম বেয়ে মোবাইল ফোনের পর্দায় পৌঁছয়, তখন কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে ফারাকটি অতি ক্ষীণ হয়— কোন দৃশ্যটি কতখানি বিনোদন দেয়, কতখানি ক্রুদ্ধ করে, কতখানি প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলে, সে হিসাব রাখা দুষ্কর হয়।

বিদায়ী বছরে বার বার, প্রতিশোধকামী এই অন্ধ রাগের ফাঁদে পড়েছে জেন জ়ি। কারণ অনলাইনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় তারা, তাই তারাই এই টোপ গিলছে আগে। পরিণতমনস্ক হয়ে ওঠার আগেই তারা রাগকে চিনছে পৌরুষের একমাত্র প্রকাশ হিসাবে; হিংসা আর বলপ্রয়োগকে ভাবছে প্রকৃত সমাধানসূত্র।এমনকি, ন্যায্য দাবিকে ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলনও তার অভিব্যক্তি খুঁজছে অসহনীয় হিংসার বয়ানে। ক্রোধ, আগ্রাসন এখন আর কোনও ঘটনার প্রতিক্রিয়ামাত্র নয়, তা যেন যুবসমাজের, জনতার স্বাভাবিক অবস্থান।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

anger Gen Z

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy