কলকাতা পুরসভার হাবভাব দেখে ক্ষেত্রবিশেষে অবোধ শিশুর কথা মনে পড়ে। মহানগরে ঘটা প্রতিটি দুর্যোগ, অব্যবস্থা, নাগরিক-যন্ত্রণাকে সে যেন প্রতিনিয়ত শিশুর বিস্ময়ে আবিষ্কার করে। অবশ্য, শিশু যা শেখে, তাকে হাতেকলমে প্রয়োগ করতে চায়। পুরসভার সেই প্রচেষ্টাটুকুও নেই। বর্ষাকালে যেমন কয়েক দফা প্রবল বৃষ্টির পর মধ্য কলকাতায় যান-ভোগান্তি চরমে উঠলে তারা হঠাৎ উপলব্ধি করে যে, সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন তৈরি হওয়ার পর তার নীচে থাকা নিকাশির পথটি সরু হয়ে বেঁকে গিয়েছে। তার জেরেই ওই এলাকায় জল বেরোতে দেরি হচ্ছে। অথচ, সমস্যাটি দীর্ঘ দিনের। সবিনয় প্রশ্ন, নিকাশির এই সমস্যা দূর করতে কি অতঃপর নাগরিক তৎপর হবেন?
বর্ষাকালে শহরে বৃষ্টি হবে, খামখেয়ালি আবহাওয়ার কারণে কোথাও কম সময়ে অধিক বৃষ্টি হবে, গামলার মতো আকৃতির মহানগরে জলও জমবে, এবং সেই জমা জলের সমস্যা দূর করতে পুরসভাকেই উদ্যোগী হতে হবে— এ সব কথা কি পুরসভার অজানা? প্রতি বার কয়েক পশলা ভারী বৃষ্টির পর শহরবাসী যানজট আর জমা জলে অবরুদ্ধ পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করেন, আর পুরসভা হিসাবের খাতা বার করে আওড়ে চলে, কলকাতার কোথায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হওয়াতে জল জমতে বাধ্য হয়েছে, কোথায় সেই জল ‘পুরসভার তৎপরতা’য় আগের চেয়ে বেশি দ্রুত বার করা সম্ভব হয়েছে। এই কুনাট্য থেকে, আপাতত, কলকাতাবাসীর মুক্তি নেই। জল জমার সমস্যাটি শুধুমাত্র ঘণ্টাকয়েকের দুর্ভোগ নয়। এর সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটি জড়িত। কলকাতায় সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার যে ঘনিষ্ঠ যোগ দেখা যাচ্ছে, তার অন্যতম কারণ জল জমার সমস্যা। এবং এই সমস্যা শুধুমাত্র নিচু এলাকাগুলির নয়। মহানগরের বিভিন্ন অংশে খানাখন্দ সমৃদ্ধ রাস্তাগুলিতেও দীর্ঘ সময় জল জমে থাকছে। সেখানে এক দিকে মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, অন্য দিকে জল এবং গর্তবোঝাই রাস্তাগুলি ‘মরণফাঁদ’। কোথাও আবার রাস্তার জমা জলে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে প্রাণ কাড়ছে পথচারীর।
এই কি এক আধুনিক শহরের আদর্শ ছবি? এক সময় কলকাতার জমা জল অপেক্ষাকৃত ঢালু পূর্ব কলকাতার জলাভূমিতে গিয়ে পড়ত। কিন্তু সে জায়গা প্রোমোটার চক্র ও বেআইনি জবরদখলকারীদের হাতে চলে যাওয়ায় শহরে জল জমার সমস্যা ঘনীভূত হয়েছে। সমাধানের লক্ষ্যে গত বছর পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর উদ্যোগী হয়ে কলকাতা পুরসভার সঙ্গে রাজ্যের একাধিক পুরসভাকে চিঠি পাঠিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বৃষ্টিতে বেশি জল জমার জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করে জানাতে হবে, তদনুযায়ী ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সম্প্রতি নিম্নচাপের বৃষ্টি প্রমাণ করল, সেই ব্যবস্থার সুফল এই বর্ষায় পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরও এক বার মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, বর্ষা এলে ঘুম ভাঙা নয়, হরেক প্রকল্পের গল্প শোনানোও নয়, বরং শহরের চার পাশের খাল, নিকাশি নালাগুলির সংস্কার, প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, রাস্তার গর্তগুলির মেরামতি— এগুলিকে সম্বৎসরের কর্মসূচিতে জায়গা দিতে হবে। পুর-প্রশাসনে পালাবদলের পনেরো বছর অতিক্রান্ত। আর কবে সাবালক হবে কলকাতা পুরসভা?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)