E-Paper

বিপন্ন দ্বীপপুঞ্জ

জাতীয় স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কাজকর্ম হবে— তাতে আপত্তি থাকার কথা নয়, যদি সেই উন্নয়ন সুস্থায়ী এবং পরিবেশবান্ধব হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমনটি হওয়ার লক্ষণমাত্র নেই। বরং দ্বীপপুঞ্জের অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা দু’ভাবে।

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৩৫

আরাবল্লী পাহাড় নিয়ে শীর্ষ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিতর্ক এখনও থামেনি। নবনির্মিত সংজ্ঞায় ভূষিত আরাবল্লীর ভবিষ্যৎ ‘উন্নয়ন’-এর কোপে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই জানা গিয়েছে, আর এক জীববৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চল গ্রেট নিকোবর দ্বীপপুঞ্জও ভারত সরকারের সুবিস্তৃত উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আলোচনাসভাতে উঠে এল উন্নয়নের আড়ালে অন্ধকার ভবিষ্যৎটির কথা। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য, সিঙ্গাপুর এবং হংকং-এর আদলে ক্রান্তীয় বনভূমি আচ্ছাদিত অঞ্চলে এক অত্যাধুনিক শহুরে বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলা, যা মলাক্কা প্রণালীর কাছে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জের কৌশলগত অবস্থানের কারণে জাতীয় স্বার্থের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণও বটে।

জাতীয় স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কাজকর্ম হবে— তাতে আপত্তি থাকার কথা নয়, যদি সেই উন্নয়ন সুস্থায়ী এবং পরিবেশবান্ধব হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমনটি হওয়ার লক্ষণমাত্র নেই। বরং C। প্রথমত, প্রকল্প অঞ্চলটি ‘গ্রেট নিকোবর বায়োস্ফিয়ার রিজ়ার্ভ’-এর অভ্যন্তরে সংরক্ষিত অরণ্যের অংশ। স্থানীয় প্রাণিসম্পদের প্রায় ২৪ শতাংশের ঠিকানাও এই অঞ্চলটি। উন্নয়নের ধাক্কায় তাদের বিরাট অংশই অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে মেগাপোড পাখি থেকে শুরু করে গ্যালাথিয়া খাঁড়িতে ডিম পাড়তে আসা বিশালাকায় লেদারব্যাক সি টার্টলও। সমুদ্র দূষিত হলে হারিয়ে যেতে পারে বহু সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ, ধ্বংস হবে সুবিস্তৃত প্রবাল প্রাচীরও। তা ছাড়া কয়েক লক্ষ ক্রান্তীয় বৃক্ষ কাটা পড়বে। তার ধাক্কায় স্থানীয় বর্ষাচক্রের ছন্দটি বিপুল ভাবে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা। সামগ্রিক ভাবে ভারতের উপরেও যে এর প্রভাব পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কই? এই ক্ষতি পূরণের কথাও অবশ্য বলা হয়েছে। দশ লক্ষ ক্রান্তীয় বৃক্ষের পরিবর্তে গাছ লাগানো হবে হরিয়ানা ও মধ্যপ্রদেশে। হাস্যকর প্রয়াস। ক্রান্তীয় অরণ্য ও তাকে ঘিরে থাকা বাস্তুতন্ত্র সুদীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠে। পরিকল্পিত অরণ্য সৃষ্টি করে সেই ক্ষতিপূরণ অসম্ভব। ইতিপূর্বেও দেশের ক্রান্তীয় বা প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট অরণ্যগুলিকে নির্বিচারে কেটে কিছু পরিকল্পিত অরণ্য সৃষ্টির মাধ্যমে খাতায়-কলমে অরণ্য আচ্ছাদন অটুট দেখানোর প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে। এই হিসাবের গোঁজামিল শেষ পর্যন্ত দেশের পরিবেশগত ভারসাম্যে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

অন্য ক্ষতির সম্ভাবনাটি দ্বীপপুঞ্জের জনজাতিভুক্তদের জীবনে। এই দ্বীপের জনসংখ্যা আট হাজারের কাছাকাছি। উন্নয়নের পর তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে সাড়ে আট লক্ষে। এই বৃদ্ধিকে ধারণ করা স্বল্পায়তন দ্বীপটির পক্ষে সম্ভব কি না, প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কী হবে এখানকার জনজাতিভুক্তদের? তাঁদের সংখ্যা এমনিতেই ক্রমহ্রাসমান। আধুনিক বিশ্ব থেকে নিজেদের পৃথক করে রাখা জনজাতিভুক্তরা পরিবেশের এই আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেবেন কোন উপায়ে? না কি তাঁদের স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব সংস্কৃতির পরিসরটুকুকে কেড়ে জবরদস্তি মিশিয়ে দেওয়া হবে ‘আধুনিক বিশ্ব’-এর সঙ্গে? এক দিকে জলবায়ু পরিবর্তন, অন্য দিকে আগ্রাসী উন্নয়নের চাপে সারা বিশ্বেই দুর্বল, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলি কোণঠাসা। ভারত সেই তালিকাকেই বিস্তৃততর করছে মাত্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Andaman and Nicobar Great Nicobar island

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy