নাগরিক আইন ভাঙলে প্রতিকারের জন্য প্রশাসন থাকে। কিন্তু প্রশাসন যখন নিজের তৈরি আইন নিজেই ভাঙে, প্রতিকার করবে কে? কলকাতা ও হাওড়ার এক বিরাট অংশ জুড়ে সম্প্রতি যে বেআইনি বহুতলের রমরমা, তাতে এই প্রশ্নটি নাগরিককে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। আশঙ্কা গভীরতর হয় যখন শোনা যায়, বেআইনি নির্মাণগুলি শুধু পুরসভার অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়েই নির্মিত হয়নি, বরং খোদ পুরসভাই এমন নকশার অনুমোদন দিয়েছে যা পুর আইনকে সরাসরি অমান্য করে। রাজ্যের প্রধান সচিবালয় নবান্নের কাছে এমনই এক বহুতলের সন্ধান মিলেছে, যা নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়মের প্রমাণ একাধিক ও গুরুতর। নবান্নকে ঘিরে ৫০০ মিটারের মধ্যে বহুতল তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এই নির্মাণে ছাড়পত্র মিলেছে। যে স্থানে সেটি গড়ে উঠেছে তা অতি অপ্রশস্ত, দমকলের গাড়ি ঢোকার জায়গাও নেই। এখন জানা যাচ্ছে শুধু এই একটিই নয়, নবান্ন সংলগ্ন আরও একটি রাস্তার বহুতল-সহ হাওড়ার কয়েকটি ওয়ার্ডে অন্তত কুড়িটি বহুতল নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে পুর আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে। সঙ্কীর্ণ স্থানে বহুতল নির্মাণের পরিণতি কী হতে পারে, একাধিক অগ্নিকাণ্ড বার বার তা দেখিয়েছে। তবু পুরসভার উদাসীনতা অব্যাহত। নিয়ম ভাঙার তালিকা দীর্ঘ, অথচ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয়নি।
বহুতলে দুর্ঘটনা ঘটার পর কিছু দিন পুরসভা নড়েচড়ে বসে। সব বেআইনি নির্মাণ চিহ্নিত করে ভেঙে দেওয়া, নিয়মভঙ্গকারীদের শাস্তি-সহ নানা আশ্বাসবাণী শোনা যায় কর্তাদের মুখে। কিন্তু কলকাতা ও হাওড়ায় এ যাবৎ যে পরিমাণ বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে, তার তুলনায় দণ্ডিতের সংখ্যা কত? পুরসভার হিসাবই বলছে, গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে শুধুমাত্র গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ এলাকায় ১২৭টি বেআইনি নির্মাণ ছিল। এখনও পর্যন্ত তাদের কতগুলি ভাঙা পড়েছে? গার্ডেনরিচ কাণ্ড ও একাধিক জায়গায় বাড়ি হেলে পড়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে বাসিন্দাদের অসচেতনতাকেই প্রকারান্তরে দায়ী করে পুরসভা জানিয়েছিল, সস্তায় ফ্ল্যাট পাওয়ার হাতছানিতে পা না দিয়ে ফ্ল্যাটের নকশা পুরসভা দ্বারা অনুমোদিত কি না, দেখে নেওয়া জরুরি। প্রশ্ন হল, স্বয়ং পুরসভাই যদি বেআইনি নির্মাণে অনুমোদন দিয়ে থাকে, তবে বাসিন্দারা সতর্ক হবেন কোন পথে?
অবৈধ নির্মাণ আটকানোর দায়িত্ব পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের উপর ন্যস্ত। সেই দায়িত্ব পালন যে যথাযথ হচ্ছে না, পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে যতগুলি মামলা করা উচিত ছিল, গত দু’বছরে সেই সংখ্যাটিও যথেষ্ট কমেছে। নিঃসন্দেহে বেআইনি নির্মাণের ভিতটি পোঁতা হয়েছিল বাম আমলেই। সিন্ডিকেট রাজেরও শুরু তখন থেকে। সেই দুর্নীতিই এই আমলে আড়ে-বহরে বেড়েছে। প্রকাশ্যে জলাজমি বুজিয়ে নির্মাণের ধারাটি ক্রমশ বেলাগাম হয়েছে; ক্ষমতার পরিবর্তনের পরও পুরসভার শিথিল, ত্রুটিপূর্ণ কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেনি। বরং, পুরসভার কথা ও কাজের বিরাট ফারাক দেখে আশঙ্কা হয়, এই ক্ষেত্রটিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ কমছে। পুরসভার ভিতরে ঘুঘুর বাসা, অসাধু প্রোমোটারের সঙ্গে রাজনীতির যোগ এবং সদিচ্ছার অভাব— ত্র্যহস্পর্শে আলগা হচ্ছে বহুতলের তলার মাটি। ফের একটি বিপর্যয় সময়ের অপেক্ষামাত্র।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)