অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণে যুক্ত কারিগরদের অনেকেই কাজ করছেন দিঘার জগন্নাথ মন্দিরেও, দেশের দুই প্রান্তের দুই মন্দিরের মধ্যে এই মিলটি যদি সমাপতন না-ও হয়, তবে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। প্রবল তাৎপর্যপূর্ণ মিলটি হল, রাজনৈতিক ভাবে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি দল ঠিক এক ভঙ্গিতে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা লঙ্ঘন করে মেতে উঠল সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের মন্দির নির্মাণে। অযোধ্যায় প্রধানমন্ত্রী, আর দিঘায় মুখ্যমন্ত্রী— কেউ নিজের হাতে পূজা করে, আর কেউ যজ্ঞে আহুতি দিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে— নিজের হিন্দুত্বের প্রমাণ পেশ করলেন। ভারতের সংবিধান যে রাষ্ট্রকে এ ভাবে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুমতি দেয় না, দেখা গেল যে, সে কথাটি মনে রাখার দায় কোনও তরফেরই নেই। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সমস্ত ধর্ম-বর্ণের মানুষ যোগ দিয়েছেন জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনে। যদি সত্যিই তাই হয়, তাতেও কিছু আসে যায় না। অনুষ্ঠানটির ধর্মীয় চরিত্র তাতে পাল্টায় না— হিন্দু ধর্মের মন্দির কোনও মন্ত্রবলে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে না। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন গোটা দেশ জুড়েই নতুন করে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ তীব্র হয়ে উঠছে— মুর্শিদাবাদ-পরবর্তী অধ্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে মুসলমানরা অতি বিপন্ন বোধ করছেন— ঠিক সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মন্দির উদ্বোধন করে কী বার্তা প্রেরণ করলেন, তা বোঝার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁর নিশ্চিত ভাবেই আছে। এবং, সব সীমারেখা অতিক্রম করে তিনি রাজ্যের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের উপরে ন্যস্ত করলেন বাড়ি-বাড়ি প্রসাদ পৌঁছে দেওয়ার ভার। প্রশাসন যে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মিবর্গ নয়, এ কথাটিও আর স্মরণে থাকেনি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মন্দির উদ্বোধনের পূজা করলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে তাতে হতাশ অথবা ক্ষুব্ধ হওয়া যেতে পারে, কিন্তু অবাক হওয়ার অবকাশ তাতে নেই। তাঁর রাজনীতি হিন্দুত্ববাদের; সংবিধান-বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিজেপির রাজনীতি চিরকাল একটি বালাই জ্ঞান করে এসেছে— এবং, প্রধানমন্ত্রীও কখনও নিজেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন বলে অভিযোগ নেই। বিপ্রতীপে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত মৌখিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতারই রাজনীতি করেন। শোনা যায়, ভারতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের মুখে তিনিই নাকি শেষ এবং কঠিনতম প্রতিরোধ। মন্দিরের উদ্বোধনে তাঁর সাগ্রহ ও সক্রিয় উপস্থিতি সে কারণেই ভারতবাসীকে আরও বেশি হতাশ করবে। কেউ বলতেই পারেন যে, প্রতি বছর ইদের জামাতে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই আপত্তি ওঠে না কেন? উত্তরটি বহুমাত্রিক, কিন্তু আপাতত একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি— সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের সঙ্গে শাসকের সংযোগ সংখ্যালঘুকে বিপন্নতর করে। সংখ্যালঘুর প্রতি শাসকের নৈতিক কর্তব্য তাঁকে এই কাজটি করার অনুমতি দেয় না।
মন্দির প্রতিষ্ঠায় মুখ্যমন্ত্রীর অত্যুৎসাহের কারণ স্পষ্ট— রাজ্যে বর্ণহিন্দু পুরুষ ভোট যে ভাবে বিজেপির দখলে চলে যাচ্ছে, তাতে তিনি উদ্বিগ্ন। সমাধান হিসাবে যে পথটি বেছে নিয়েছেন, তা অবশ্য সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নতুন নয়; এমনকি, তাঁর পক্ষেও নতুন নয়। প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বের রাজনীতি তিনি এর আগেও করেছেন— কখনও গঙ্গা অথবা পাড়ার পুকুরের ঘাটে আরতির ব্যবস্থা হয়েছে, কখনও আবার দোল উপলক্ষে নিরামিষ খাওয়ার ফরমান জারি করেছে তৃণমূল-পরিচালিত পুরসভা। কিন্তু, আগমার্কা হিন্দুত্ববাদী বিজেপির বিপ্রতীপে নরম হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে চাওয়া তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি যে হিন্দু ভোটের নাগাল পায় না, এ কথাটি মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে নিতে পারেন। দিঘার মন্দির থেকে তাঁর রাজনৈতিক লাভ কী, তিনি জানেন— ক্ষতি: অতঃপর নিজেকে বিজেপির হিন্দুত্ব রাজনীতির বিরোধী হিসাবে দেখাতে গেলে তা অন্তঃসারশূন্য ঠেকবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)