E-Paper

চক্রবৎ

পথচারীদের বাধাহীন ভাবে ফুটপাত ব্যবহারের অধিকার সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবনের মৌলিক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৫ ০৬:৩৮

পথচারীদের কাছে পরিচ্ছন্ন, হাঁটার যোগ্য ফুটপাতের গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ রকমারি দোকান, অস্থায়ী ছাউনি, মন্দির, সৌন্দর্যায়নের বিচিত্র উপকরণের চাপে ইদানীং কালে তার মূল উদ্দেশ্যটিই যেন চাপা পড়ে গিয়েছে। ফুটপাতের সেই বিস্মৃত অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে: সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশ। আগামী দু’মাসের মধ্যে পথচারীদের অধিকার সুরক্ষিত করতে দেশের সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে নির্দেশিকা প্রস্তুত করতে হবে। শীর্ষ আদালত আরও জানিয়েছে, পথচারীদের বাধাহীন ভাবে ফুটপাত ব্যবহারের অধিকার সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবনের মৌলিক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অবশ্যই সেই ফুটপাতকে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদেরও সহজে ব্যবহারের উপযোগী হতে হবে এবং সমস্ত জবরদখল মুক্ত রাখতে হবে।

ফুটপাত ব্যবহার নাগরিকের মৌলিক অধিকার— এই ব্যাখ্যাটি দীর্ঘ প্রশাসনিক অবহেলার সপাট জবাব। ব্যস্ত রাস্তার পাশে ফুটপাত নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য এক দিকে পথচারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অন্য দিকে রাস্তায় গাড়ি চলাচল মসৃণ রাখা। যে কোনও সভ্য দেশে এই ব্যবস্থাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশাসনিক বদান্যতায় এ দেশে উল্টো চিত্রটিই নিয়ম। কয়েক দশক ধরে ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে প্রশাসনিক টানাপড়েন কলকাতার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গে এই প্রশ্নের সামনে বাম দলগুলি তীব্র বিরোধিতায় নেমেছিল। অতঃপর বাম আমলে ১৯৯৬ সালে শুরু হয়েছিল অপারেশন সানশাইন— ফুটপাত হকারদের দখলমুক্ত করার ঐতিহাসিক প্রকল্পটি চলেছিল দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ‘জনবিরোধী’ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীরা, যার মধ্যে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও। হকারদের মধ্যে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় রাজনৈতিক দ্বিধা ও জটিলতা সব পক্ষেই ছিল তুঙ্গে। বলা বাহুল্য, এর পর তৃণমূল কংগ্রেস আমলেও একই সঙ্কট একই তীব্রতায় অব্যাহত থাকে।

প্রসঙ্গত, গত বছর মুখ্যমন্ত্রী ফুটপাত দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন। যে সব কাউন্সিলর টাকা নিয়ে ফুটপাত দখলে উৎসাহ দেন, তাঁদের গ্রেফতারির আদেশও শোনা যায়। জেলায় জেলায় উচ্ছেদ অভিযানে নেমে পড়ে প্রশাসন। কিন্তু বুলডোজ়ার দিয়ে দখলমুক্তির অভিযানে সায় ছিল না মুখ্যমন্ত্রীর, পুনর্বাসনের জটিলতাও উচ্ছেদ অভিযানের রাশ টেনে ধরে। কিছু দিনের টানাপড়েনে ফুটপাত ফের বন্দি হয় বিক্রেতা এবং জবরদখলকারীদের হাতে। আপাতত কলকাতা শহরের কোনও প্রান্তে সেই উচ্ছেদ অভিযানের চিহ্নমাত্রও নেই। মাঝেমধ্যে পুরসভার হুঙ্কার শোনা যায় বটে যে, ফুটপাতের এক-তৃতীয়াংশের বাইরে হকার বসতে দেওয়া হবে না— কিন্তু আজও ফুটপাত রয়েছে তার স্ব-চরিত্রেই, জীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত, ভারাক্রান্ত অবস্থায়। এক দীর্ঘ ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশটি বিশেষ গুরুতর। হকারদের রুজিরুটি অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে ফুটপাতের চৌহদ্দির বাইরে সুবিধাজনক পরিসরে বিকল্প ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ইতিহাসের ফাঁদ থেকে বেরোনো কঠিন হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়। প্রশ্ন হল, বহুদশকব্যাপী এই সঙ্কট থেকে রাজ্যকে মুক্ত করার কাজটি কি ভোটরাজনীতির কারবারিরা করে উঠতে পারবেন?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

footpaths Kolkata Mamata Banerjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy