E-Paper

দমনেই সমাধান?

নরেন্দ্র মোদী সরকারের বহু কার্যকলাপ ইতিমধ্যে যথেষ্ট ভাবেই প্রমাণ করেছে যে গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে এসে বর্তমান ভারত অন্য কোনও দিকে হাঁটা দিয়েছে।

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৩

নিজেরা সঙ্কট তৈরি করে, নিজেরাই সেই সঙ্কট গভীরতর করে তুলে, তার পর ‘শত্রু’ বা প্রতিপক্ষের ঘাড়ে সেই সঙ্কটের দায় চাপিয়ে দমনপন্থা অবলম্বন করলে, কতগুলি পাখি এক ঢিলে মারা হয়? লাদাখে কেন্দ্রীয় শাসনের অন্ত ঘটিয়ে স্বশাসনের দাবিতে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ প্রবল আকার ধারণ করার পর নরেন্দ্র মোদী প্রশাসন যে ভাবে বিশিষ্ট প্রতিবাদী নাগরিক সোনম ওয়াংচুককে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করল, ঘটনার পারম্পর্য থেকে অনুমান— কেন্দ্রীয় বিজেপির এই একাধিক পক্ষীঘাতক ‘ঢিল’টির পিছনে অনেক রাজনৈতিক হিসাব আছে। সোনম ওয়াংচুকের নেতৃত্বে লাদাখবাসীর অনশন শুরু নিশ্চয়ই এ অঞ্চলে বিক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। অনশনের পনেরো দিন কেটে যাওয়ার পর ২০ তারিখ আরও পনেরো দিনের ব্যবধানে ৫ তারিখ বৈঠকের ঘোষণায় বোঝা গিয়েছে, প্রশাসনের তরফে অনশন-মৃত্যুর বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য বলেই মনে করা হয়নি— সেই সংবেদনহীনতাও তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ বাড়িয়েছে। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তারা হিংসার আশ্রয় নিয়েছে, দেশেবিদেশে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। হিংসার সেই প্রচণ্ডতাকে রোধ করা প্রশাসনের কর্তব্য, সন্দেহ নেই। তবে হিংসার কতখানি দায়িত্ব খোদ সোনম ওয়াংচুকের, তার সামগ্রিক তদন্ত ছাড়াই তাঁকে কঠোরতম জামিনবিহীন আইনে গ্রেফতার করে লাদাখ থেকে জোধপুরের জেলে নির্বাসিত করার পদক্ষেপটি অবাক করার মতো।

আঞ্চলিক দাবিতে কোনও আন্দোলন শুরু করার ‘অপরাধ’-এ কি এই ভাবে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারই একমাত্র পথ? বিশেষত যখন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পরই একাধিক বার সোনম ওয়াংচুক বিরোধীদের শান্ত হতে অনুরোধ জানিয়েছেন, নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনশন ভঙ্গ করেছেন? স্বভাবতই মনে পড়ে, আরও কত বার ঠিক এই ভাবেই বিরোধিতা দমন করেছে মোদী সরকার। বিরোধী রাজনীতির ধাক্কা সামলানোর নামে সোজাসুজি সমালোচক বা বিরোধীকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিস্পর্ধী নামে অভিহিত করে তাঁকে/তাঁদের কঠোরতম শাস্তি দিয়েছে। প্রসঙ্গত, লে-র অ্যাপেক্স বডি-র চেয়ারম্যান চেরিং দোরজি জানিয়েছেন, অন্তত চার আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে, আরও অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার সব কিছুর পিছনেই সোনম ওয়াংচুক ও অন্য নেতাদের উস্কানি দেখছেন, উল্টো দিকে বিরোধীরা আনছেন চক্রান্তের অভিযোগ। প্রশ্ন কিন্তু উঠবেই, কেন এই অনশন আন্দোলন আদৌ শুরু হয়েছিল? পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা-সহ চার দফা দাবিতে পাঁচ বছর ধরে যে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ভাবে চলছে, হঠাৎ কেন তা এই ভাবে অশান্ত হয়ে উঠল? তাতে কি কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বই সর্বাধিক নয়?

লাদাখের স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি যুক্তিসঙ্গত কি না, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও গণতান্ত্রিক আদানপ্রদানের প্রয়োজন আছে। লাদাখবাসীর দাবি, তাঁদের অসম, মেঘালয়, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরার মতো ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র ও বিশিষ্ট জনজীবন অক্ষুণ্ণ থাকে। বাস্তবিক, এই দাবির যৌক্তিক ভিত্তিটি উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। জম্মু ও কাশ্মীরেও ইতিমধ্যে একই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ওমর আবদুল্লা যথার্থই বলেছেন, লাদাখ ও জম্মু-কাশ্মীরে একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একই ভাবে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে, দুই ক্ষেত্রেই সবলে আঞ্চলিক অধিকারের দাবি প্রতিরোধ করে চলেছে। মুশকিল হল, কেবল বলপ্রয়োগ দিয়ে এত বড় বড় সমস্যা সমাধান করা যায় না। কথায় কথায় জাতীয় নিরাপত্তা আইনের মুষ্ট্যাঘাত দিয়েও বিরোধিতা ও আন্দোলন দমন করা যায় না। সেটা করলে সেই শাসককে আর গণতান্ত্রিক বলা যায় না। অলমতি বিস্তরেণ। নরেন্দ্র মোদী সরকারের বহু কার্যকলাপ ইতিমধ্যে যথেষ্ট ভাবেই প্রমাণ করেছে যে গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে এসে বর্তমান ভারত অন্য কোনও দিকে হাঁটা দিয়েছে। অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Narendra Modi Leh Ladakh

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy