E-Paper

প্রত্যাশা অতিক্রমী

পুরুষদের জন্য অর্ধেক আসন সংরক্ষণের নির্দেশ জারি করতে হয়েছে একাধিক সড়ক পরিবহণ নিগমকে। মেয়েদের প্রতি ন্যায়ের ইচ্ছা মাত্র দু’বছরের মধ্যে পরিণতি পাচ্ছে সকলের জন্য ন্যায়ের উদ্যোগে।

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৫ ০৫:৩২

কর্মফল ভোগ করতে হয়, কিন্তু এক কর্মের ফল তো আর একটা নয়। কোন ফলটি কোন রূপ নিয়ে উদয় হবে, আগাম বোঝা দুঃসাধ্য। মাঝেসাঝে সেই ফল মিঠেও হয়। যেমন হল কর্নাটকে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস নেতা সিদ্দারামাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি মেয়েদের বাসযাত্রা ফ্রি করে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি কথা রেখেছেন— ২০২৩ সালে ‘শক্তি’ প্রকল্প চালু করেছেন, যাতে মেয়েদের সরকারি বাসে টিকিট কিনতে না হয়। ফল কী হল? সম্প্রতি কর্নাটক সরকার চোদ্দো হাজার নতুন বাসের জন্য আবেদন করেছে কেন্দ্রের কাছে। আবেদন মঞ্জুর হলে কর্নাটকের গণপরিবহণে নতুন রক্তসঞ্চার হবে। এর প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট— গত এক দশকে কর্নাটকে মানুষ বেড়েছে এক কোটিরও বেশি, কেবল বেঙ্গালুরুতেই ষাট লক্ষ। অথচ, বাসের সংখ্যা বাড়েনি। মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে বাসযাত্রা চালু করার পরে বোঝা গেল, রাজ্যে গণপরিবহণের প্রকৃত প্রয়োজন কতখানি। বাসভাড়ার অঙ্ক হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু সেটুকুও ‘নষ্ট’ করতে না চেয়ে কত মেয়ে নিজেদের নিবৃত্ত করেছেন বাসযাত্রা থেকে, তার আন্দাজ মিলেছে পরিসংখ্যানে— প্রকল্প শুরুর আগে মেয়েরা ছিলেন বাসযাত্রীদের এক-তৃতীয়াংশ। এখন তাঁরাই দুই-তৃতীয়াংশ। পুরুষদের জন্য অর্ধেক আসন সংরক্ষণের নির্দেশ জারি করতে হয়েছে একাধিক সড়ক পরিবহণ নিগমকে। মেয়েদের প্রতি ন্যায়ের ইচ্ছা মাত্র দু’বছরের মধ্যে পরিণতি পাচ্ছে সকলের জন্য ন্যায়ের উদ্যোগে। অর্থনীতির পরিভাষায় এ হল ‘পজ়িটিভ এক্সটার্নালিটি’— কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি কাজ করা হলে তার ফল যখন উদ্দিষ্টকে ছাপিয়ে অন্যান্য সুফল দেয়, তখন সেই ‘অতিরিক্ত সুফল’-কে বোঝায় এই শব্দবন্ধ। যেমন, মেয়েদের যাত্রাকে উৎসাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রকল্প চালু করলেও, সরকারি বাস বাড়লে তার সুফল পাবেন পুরুষরাও।

সরকারি কোনও নীতি বা প্রকল্পের এমন অপ্রত্যাশিত সুফল নানা দেশে, নানা সময়ে দেখা গিয়েছে। তেমন একটি বহু-বিতর্কিত সুফল, আমেরিকায় গর্ভপাত বৈধ করার ফলে অপরাধের সংখ্যা কমে যাওয়া। অর্থনীতিবিদ জন ডোনাহু এবং স্টিভ লেভিট পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে, সত্তরের দশকে আমেরিকার গর্ভপাতের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ফলে হিংস্র অপরাধের হার কমেছে প্রায় অর্ধেক, সম্পত্তি নষ্ট করার অপরাধ কমে গিয়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল, অবাঞ্ছিত সন্তানদের পরিবার যথাযথ পরিচর্যা, সুরক্ষা দিতে পারে না, তাই তারা সহজেই জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। এই দাবি নিয়ে অবশ্য বহু প্রশ্ন উঠেছে, অনেকেই একে অপরাধের অতি-সরলীকরণ বলে সমালোচনা করেছেন। তবে পরবর্তী কালের গবেষণাতেও গর্ভপাতকে বৈধ করার নীতির সঙ্গে অপরাধের হার কমার সম্পর্ক বজায় থাকছে। মনে করা হচ্ছে, কার্যকারণ সম্পর্ক যদি না-ও হয়, তবু গর্ভপাতের বৈধতার সঙ্গে অপরাধ কমার সংযোগ আছে। তেমনই একটি আশ্চর্য সুফল দেখেছে ব্রাজ়িল— টেলিভিশনে ‘সোপ অপেরা’ চালু হওয়ার পর সেখানে কমে গিয়েছে মেয়েদের সন্তানসংখ্যা। ব্রাজ়িলে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সংখ্যা বেশি, সরকার পরিবার পরিকল্পনাকে বিশেষ উৎসাহ দেয় না। তা সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশক থেকে ব্রাজ়িলে জনসংখ্যা দ্রুত কমেছে। গবেষকদের মতে তার অন্যতম কারণ, সিরিয়াল নাটিকাগুলিতে নারীচরিত্রগুলি হয় সন্তানহীন, নয়তো তাদের একটি সন্তান। সন্তানপালন আর গৃহকাজ-সর্বস্ব জীবনের বিকল্প এক আকর্ষণীয় জীবন দেখে মেয়েদের আকাঙ্ক্ষার অভিমুখ ঘুরে গিয়েছে। ভারতেও কেব‌্‌ল টিভি প্রবেশের পরনানা প্রদেশে মেয়েদের মনোভাবে নানা সদর্থক পরিবর্তন পেয়েছেন সমীক্ষকরা।

কোথা থেকে আসে এই অপ্রত্যাশিত, অতিরিক্ত সুফল? আসে ভিতর থেকেই। মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা, স্বাতন্ত্র্যের জন্য আকুলতা, পরস্পর সংযোগের ইচ্ছা, এমন নানা মনোবাসনার দরজা এমন শক্ত করে এঁটে রাখে সমাজের বিধি-রীতি, যে দৈনন্দিন জীবন-সংগ্রামে ব্যস্ত মানুষ তার অস্তিত্বকেই ভুলতে বসে। রাষ্ট্র বা বাজারের কোনও কাজে দৈবাৎ শিকল একটু আলগা হলে, ফাঁক পেয়ে বেরিয়ে আসে ইচ্ছাগুলো। সেই ইচ্ছার শক্তি ভাঙেপ্রচলিত নকশা, গড়ে নতুন দেশ। যা ছিল অতিরিক্ত লাভ, তা ক্রমশ আপাত-লাভকে ছাড়িয়ে দেয়। কর্নাটকের এক বাসযাত্রী মহিলা বলেছেন, “আগে মেয়েরা অদৃশ্য ছিল। এখন আমাদের সবাই দেখতে পায়।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Government Schemes Karnataka

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy