E-Paper

আশ্রয়হীন

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে যে ‘অ্যাডাপটেশন’-এর প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের সঙ্গে সম্প্রদায়গুলিকে যুঝতে সাহায্য করার কথা বলা হয়। বলা হয়, তাতে পরিযাণের প্রয়োজনও কমতে পারে।

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৫ ০৬:৩৭

বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন— আজকের দিনে শুধুমাত্র বহু-আলোচিতই নয়, বিগত কয়েক বছরে তার প্রভাবটি ভয়ঙ্কর ভাবে অনুভূত। অথচ সেই প্রভাব মোকাবিলায় কত দূর প্রস্তুত বর্তমান পৃথিবী? বিশ্ব পরিবেশ দিবসে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটি তোলা জরুরি, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় যে অসংখ্য মানুষ প্রতি দিন বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, অন্যত্র যেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের বিষয়ে এখনও কোনও সুনির্দিষ্ট ভাবনাচিন্তা দেখা যায়নি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। ‘ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার’ প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে এ-যাবৎ প্রায় ৩৮ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হতে বাধ্য হয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যাঁরা ভিটেমাটি হারিয়ে নিজের দেশের অন্যত্র বা অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের বলা হচ্ছে ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। সমস্যা হল, আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু আইনে এখনও ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ শব্দটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অথচ, বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিযায়ীদের সংখ্যা ১২০ কোটিতে পৌঁছবে। এখনও অবধি তাঁদের অধিকাংশই স্ব-দেশে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁরা অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবেন, আন্তর্জাতিক আইনের সুরক্ষা তাঁরা পাবেন না। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক গৃহীত হয় ‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট ফর সেফ, অর্ডারলি অ্যান্ড রেগুলার মাইগ্রেশন’। এই চুক্তি পরিযাণের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘গভীর সমস্যা’ বলে স্বীকার করলেও বাস্তুহারাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্যের অধিকার সংক্রান্ত কিছু নিরাপত্তা প্রদান করলেও আইনি সুরক্ষা না থাকায় হামেশাই এই অধিকারগুলি তাঁরা পান না। কিছু স্থানীয় চুক্তি অবশ্যই আছে। যেমন— ২০২২ সালের আফ্রিকার দেশগুলি কর্তৃক গৃহীত ‘কাম্পালা ডিক্লারেশন’। কিন্তু ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ শব্দটি তারাও উল্লেখ করেনি। ফলে আইনি সুরক্ষা এখনও অধরা।

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে যে ‘অ্যাডাপটেশন’-এর প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের সঙ্গে সম্প্রদায়গুলিকে যুঝতে সাহায্য করার কথা বলা হয়। বলা হয়, তাতে পরিযাণের প্রয়োজনও কমতে পারে। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলি এই সব সমস্যাকে নানা সময় স্বীকার করে নিলেও সমাধানপথ এখনও দূর অস্ত্। আগামী দিনে ছোট, দ্বীপময়, দরিদ্র দেশগুলির ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত পরিযাণ শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সে ক্ষেত্রে আইনি সুরক্ষা ছাড়া এই মানুষগুলির জীবন কোন খাতে বইবে? আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি মনে করে, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিয়ে কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তির এখনও উপযুক্ত সময় আসেনি। কাজ হোক স্থানীয় স্তরেই। কিন্তু ক্রমবর্ধমান সমস্যাটির দিকে নজর রাখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, উভয় ক্ষেত্রেই একই সঙ্গে কাজ হওয়া প্রয়োজন। এবং সে ক্ষেত্রে কোনও একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যথেষ্ট না-ও হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রয়োজন ভিন্ন, পরিযাণের চরিত্রটিও বহুবিধ। সে ক্ষেত্রে চুক্তিও একাধিক হওয়া জরুরি। কিন্তু উষ্ণায়নের ঐতিহাসিক দায় স্বীকার করে যারা উন্নয়নশীল বিশ্বকে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণটুকু প্রদানেই সম্মত নয়, সেই উন্নত বিশ্ব ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’দের দায়িত্ব গ্রহণ করবে, এমন আশা সুদূরপরাহত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Climate Change Climate Crisis Climate Refugee Global Warming

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy