আশি বছর ধরে একটি কথা বারংবার শোনা গিয়েছে, ১৯৪৫ সালের মে মাসে যে বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছিল, আর কখনও এই পৃথিবী তেমন কিছু দেখবে না। ঘটনাক্রমে বিশ্বপৃথিবী তখনই প্রায় আত্মধ্বংসের সম্ভাবনার সম্মুখীন হয়েছিল। ফলে আশা করা হয়েছিল, আরও এক বার সেই পথে হাঁটার আগে নিশ্চয়ই বোধবুদ্ধিচালিত সভ্য দুনিয়ার মনে পড়ে যাবে যে প্রকৃত ঝুঁকিটি কী, কত ভয়ঙ্কর রকম জগৎবিনাশী। আশি বছর পর, উল্লেখযোগ্য ভাবে, এই আস্থার সুরটি ক্রমশ ক্ষীয়মাণ। বিশ্ববাতাস আজ তীব্র হিংসা-গরলে ভারী। ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে সর্বাধিক সংঘর্ষময় সীমান্তসমূহে। এমনকি বিশ্বমানের সংবাদমাধ্যমেও খোলাখুলি উচ্চারিত হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা।পরমাণু শক্তির ধ্বংসক্ষমতা কোনও গুপ্ত তথ্য নয়, অথচ জাতি বনাম জাতি, রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের সমরপ্রস্তুতি দেখে মনে হয় সেই বিপদের তোয়াক্কা না করেই তারা সংঘর্ষ উচ্চতর স্তরে নিয়ে যেতে রাজি। এই আশঙ্কার মূলটি রয়েছে একটি দুনিয়াব্যাপী হতাশার মধ্যে— বিশ্বব্যবস্থা কিংবা শৃঙ্খলাব্যবস্থা, ‘রুল অব অর্ডার’ বলে যা কিছু ভাবা হয়েছিল আশি বছর আগে যুদ্ধশেষের আবহে, এখন ক্রমশই বোঝা যাচ্ছে তা এক দিগন্তবিস্তৃত নেতি-তে পরিণত, দেশজাতি নির্বিশেষে চেষ্টা চলছে সেই ‘ব্যবস্থা’য় আঘাত হানার, এবং তার বিপ্রতীপে যাওয়ার জন্য।
সমস্যার মূল কি তবে উদারপন্থী প্রগতিবাদী বলে পরিচিত বিশ্বের আত্মশ্লাঘাময় আত্ম-কেন্দ্রিকতায় নিহিত? আট দশকে আগে যে ‘ব্যবস্থা’কে অসীম সম্ভাবনাময় এবং স্থিতিশীল বলে কল্পনা করা হয়েছিল, তার অন্তর্লীন দুর্বলতাই কি আজকের প্রতিক্রিয়াশীল বিশ্ববীক্ষার জন্মদাতা? এ সব প্রশ্ন গভীর অনুধাবন দাবি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের পঞ্চাশ বছর পর প্রখ্যাত হাঙ্গারীয়-আমেরিকান ইতিহাসবিদ জন লুকাস তাঁর বহুপঠিত বই দ্য লিগ্যাসি অব দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়র-এ লিখেছিলেন, হিটলারকে ঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে কেবল কোনও এক ব্যক্তির বিকার বা উন্মত্ততা দিয়ে তিনি বিচার্য নন। তাঁকে সঙ্কীর্ণমনা ক্ষমতালুব্ধ পাগল ভাবলে প্রকৃত বাস্তবটি অধরা থেকে যায়। তাঁর ইহুদিনিধন কার্যক্রমকে ব্যতিক্রমী নির্দয়তা ভাবারও কারণ নেই কোনও। বরং হিটলারের জার্মান রাইখের সমস্ত বিশ্বাস ও কাজের মধ্যে এক রকমের বিশ্ববীক্ষা ছিল। সেই বিশ্ববীক্ষা ভয়ঙ্কর— কিন্তু তাকে উন্মাদ বলে মনে করে ভীতির কারণটিকে কমিয়ে দেখা যায় না। কেননা সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আবারও এমন সঙ্কট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আজকে বিভিন্ন দেশে সত্তাসঙ্কটের বিকৃত কালসর্প যে ভাবে বাস্তবকে তীব্র পাকে পাকে জড়িয়ে তার শ্বাসরোধের উপক্রম করেছে, তাতে লুকাসের আশঙ্কাই সত্য হয়ে দাঁড়ায়। হিটলার বা তাঁর নাৎসি বিশ্বাদর্শকে আজ আর বোধাতীত রাজনীতি বা উন্মাদের কার্যক্রম বলে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। বর্তমান বিশ্বে নানা দেশের নানা কিসিমের মধ্যে তার নব অবয়ব। অর্থাৎ, ১৯৪৫ সালে একটি যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বিপদ শেষ হয়নি, কালনাগিনী ক্ষণকালের জন্য পাতাল-আশ্রয় নিয়েছিল মাত্র। এখন আবার গহনগহ্বর-অতিক্রান্ত মহাবিষধররূপে সে পুনরাবির্ভূত। তাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের নানা সিদ্ধান্ত ও বন্দোবস্তের মধ্যে কোথায় কত বিপদ ও ব্যর্থতা লুকিয়ে থেকে গিয়েছিল, নতুন করে আলোচনার দরকার আছে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, জরুরি আলোচ্য হতে পারে পূর্ব ইউরোপের রাজনীতি। রাশিয়া ও ইউক্রেন যে কালান্তক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আছে গত তিন বছর যাবৎ, তার শিকড়টি কিন্তু রয়েছে ওই বিশ্বযুদ্ধেরই মধ্যে। এক দিকে ইউক্রেনের মতো স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তারের অধিকার রাশিয়া দাবি করে থাকে পূর্বতন সোভিয়েট ইউনিয়নের ‘গ্রেট পেট্রিয়টিক ওয়র’-এর স্মৃতি উস্কে দিয়ে। মনে করিয়ে দেয়, হিটলারের সামরিক দাপটে যখন বাকি ইউরোপ প্রায় পূর্ণত গ্রস্ত, সেই সময়ে সোভিয়েট বাহিনীর মহাশৌর্যেই কিন্তু পূর্ব ইউরোপের ইতিহাসের চাকাটি ঘুরেছিল। আবার উল্টো দিকে, ‘নেটো’ যে ভাবে পশ্চিম ইউরোপের শক্তিসমন্বয় হয়ে ওঠে, এবং সোভিয়েট-বিরোধিতাকেই তার অস্তিত্বের প্রধান হেতু ও লক্ষ্য বানিয়ে তোলে, তার আতিশয্যও ছিল আত্মবিধ্বংসী। ক্রমশ তা মস্কোকে এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক একাকিত্বের পথে ঠেলে দেয়, পরোক্ষ প্রভাববলয় তৈরিতে মরিয়া করে তোলে। এই ইতিহাস পর্যালোচনা ব্যতীত আজকের পৃথিবীর নতুন সঙ্কটগুলির সুরাহা অসম্ভব। বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে উদারবাদী আবেগাশ্রুসজলতা অনেক হয়েছে, এখন চাই নতুন ও নিরপেক্ষ আঙ্গিকের বিশ্লেষণ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)