চতুর্থী থেকে নবমী— শুধুমাত্র কলকাতায় ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে আট হাজারের অধিক। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দু’-চাকার সওয়ারদের হেলমেট না পরার ঘটনা। না পরার যুক্তিগুলিও বহুবিধ এবং চিত্তাকর্ষক। উৎসবের দিনে সযত্ন চর্চিত চুল ঘেঁটে যাওয়া থেকে শুরু করে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্য অথবা বেমালুম ভুলে যাওয়া— সবই আছে। এতেই শেষ নয়। ধরা পড়ার পর অনেকের (কু)যুক্তি, হেলমেট না পরেও নিরাপদে থাকা যায়। কেউ আবার দাপটে জানিয়েছেন, তিনি হেলমেট না পরেও কখনও দুর্ঘটনায় পড়েননি। দেখেশুনে বোধ হয়, হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করার জন্য পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে এত কাল যাবৎ যে ‘প্রচেষ্টা’ চালানো হয়েছে, বাস্তবে তা সাধারণ নাগরিককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটিই দিতে পারেনি— পথ নিরাপত্তা আইনে কোনও ‘বিশেষ’ ছাড়ের জায়গা থাকে না। তা সর্ব ক্ষণের, প্রতি দিনের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। সে কর্তব্য যেমন অন্যদের প্রতি, ঠিক ততটাই নিজের প্রতিও।
পথ-নিরাপত্তা বিষয়ে যে এক অপরিসীম অ-শিক্ষায় এ শহরের জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, তা নিয়ে অবশ্য পুলিশ-প্রশাসনের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। প্রতি উৎসবের শেষে তাদের তরফ থেকে যে পরিসংখ্যানগুলি প্রকাশ করা হয়, তাতে শহরবাসীর বেপরোয়া প্রবণতা বিষয়ে উদ্বেগের চেয়ে পুলিশবাহিনীর প্রতি এক প্রচ্ছন্ন পিঠ-চাপড়ানি অধিক প্রকাশ পায়। এ খতিয়ান পুলিশ কী পেরেছে— মূলত সেই ছবিটি দেখাতে চায়। কিন্তু তারা কী পারেনি, আর কী পারা উচিত ছিল— সেই তথ্যগুলি অন্ধকারেই ঢাকা থাকে। এই সত্য শুধুমাত্র এই পুজোর জন্য নয়, বরং বঙ্গের প্রতি উৎসব দিনে প্রকাশ্যে জ্বলজ্বল করে। চার হাজারেরও বেশি নাগরিককে হেলমেট ছাড়া দ্বিচক্রযানে সওয়ার হওয়ার অপরাধে শাস্তিপ্রদানের তথ্য দেখে নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। বরং পুলিশ-প্রশাসনও জানে, উৎসব কালে এমন অপরাধীদের প্রকৃত সংখ্যাটি সচরাচর এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি হয়। এর মধ্যে এক বড় সংখ্যক অপরাধী স্রেফ ‘উৎসব’ বলেই পার পেয়ে যায়, অথবা কর্তব্যরত পুলিশের সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সামান্য অর্থের বিনিময়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলে। উৎসব-প্রিয় প্রশাসন সব দেখে, জেনেও সেই উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে যায়।
সর্বোপরি, বিষয়টি শুধুমাত্র হেলমেট না পরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, অত্যধিক গতি থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ শব্দবাজির ব্যবহার— সমস্ত ক্ষেত্রেই আইন অমান্য করার এক উৎকট উৎসব বঙ্গজীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে নাগরিকের শুভবুদ্ধি উদয়ের অপেক্ষা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচায়ক নয়, বরং চিত্রে-কাব্যে সতর্কবার্তায় আটকে না থেকে নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রশাসনের কঠোরতম রূপটির প্রদর্শন জরুরি। যে অভিভাবক শিশুসন্তানের মাথা খালি রেখেই ব্যস্ত সড়কে স্কুটার-বাইক নিয়ে বেরোতে পারেন, তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন, যাতে অন্যরা শিক্ষা নিতে পারেন। জরিমানার অঙ্কগুলি আরও বৃদ্ধি করা যায় কি না, ভেবে দেখতে হবে তা-ও। তবে সর্বাগ্রে দরকার, প্রশাসনের উৎসব নিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত আদিখ্যেতা বন্ধ করা। আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে নাগরিকের জীবন, সম্পত্তি রক্ষার গুরুদায়িত্বটি প্রশাসনের উপরেই অর্পিত। উৎসব যে তার ব্যতিক্রম হতে পারে না, সেই বোধটি সর্বস্তরে জাগ্রত হোক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)