সমবায় নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন কেন্দ্রীয় সমবায়মন্ত্রী অমিত শাহ। সম্প্রতি তিনি ভারতের নতুন জাতীয় সমবায় নীতি প্রবর্তনের কথা ঘোষণা করে শুনিয়েছেন ‘সমবায়কেন্দ্রিক ব্যবসার বাস্তুতন্ত্র’ গড়ে তোলার কথা। নতুন নীতির লক্ষ্য হতে চলেছে দেশের প্রত্যেকটি গ্রামে অন্তত একটি করে সমবায় প্রতিষ্ঠা করা, এবং অন্তত পঞ্চাশ কোটি মানুষকে সমবায়ের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত করা। প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে সমবায়ের সংখ্যা প্রায় ৮.৩০ লক্ষ। গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই সদস্য হিসাবে সরাসরি এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। সেই সমবায় সংখ্যারই আরও ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। বলা হয়েছে, ২০৩৪ সালের মধ্যে দেশের জিডিপি-তে সমবায় ক্ষেত্রটির অবদান তিন গুণ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা হয়েছে। এবং প্রযুক্তিগত ভাবে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রাইমারি এগ্রিকালচারাল ক্রেডিট সোসাইটি (প্যাক্স)-গুলিকে। এগুলির সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে কাজের পরিধিও। ২০৪৭ সালের বিকশিত ভারতের লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ।
গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রটিতে সমবায়গুলির অগ্রণী ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে এ-হেন পদক্ষেপটির গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। ভারতে সমবায় আন্দোলনের ইতিহাসটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ। ১৯০৪ সালে ভারতে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তন করে ‘কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটিজ় অ্যাক্ট, যা মূলত সদস্যদের ঋণদানকারী সমবায়গুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সমবায়গুলি কৃষিক্ষেত্র, ব্যাঙ্কিং এবং আবাসন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ২০০২ সালে প্রবর্তিত হয় জাতীয় সমবায় নীতি। তৎসত্ত্বেও ভারতের সমবায়গুলিকে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যেমন কৃষি ও তাঁতশিল্পের সমবায়গুলি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই দুর্বলতার পিছনে যেমন রয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, যা সময়বিশেষে স্বশাসন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে, তেমনই রয়েছে অপ্রতুল অর্থের জোগান, দুর্বল পরিচালন ব্যবস্থা, যা কালক্রমে সমবায়গুলির বিস্তার, আধুনিকীকরণ, এবং উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। তদুপরি পরিকাঠামোগত সমস্যা, সমবায় গঠনে সার্বিক উদ্যোগের অভাবটিও প্রকট। জাতপাতে বিদীর্ণ সমাজব্যবস্থায় সকলের সমান যোগদান ও প্রতিনিধিত্বের ধারণাটিও বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় সমবায়ের মূল লক্ষ্যটি অধরা থেকে গিয়েছে।
নতুন সমবায় নীতির প্রসঙ্গে গোড়ার এই সমস্যাগুলির চিহ্নিতকরণ এবং সমাধানের বিষয়েও যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি। সমস্যা রয়েছে সমবায় নির্বাচনকে ঘিরেও। বহু ক্ষেত্রেই নির্বাচন সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই রাজনৈতিক সংঘাত দেখা যায়। নয়তো সংঘাত এড়াতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বসিয়ে সমবায় চালানো হয়। দলীয় রাজনীতির এই হস্তক্ষেপ দুর্নীতি, অন্যায় পক্ষপাতিত্বের পথ প্রশস্ত করে তোলে। ব্যর্থ হয় তার আর্থিক উপযোগিতার লক্ষ্যটি। সুতরাং, উন্নয়নের স্বার্থে সর্বাগ্রে দলীয় হস্তক্ষেপ থেকে সমবায়কে সরিয়ে আনতে হবে। একদা এ দেশের সমবায়গুলি যৌথ উদ্যোগ, সম্পদের ব্যবস্থাপনা, গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতায়ন এবং আর্থিক বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য নিয়েই নির্মিত হয়েছিল। সেই মূল লক্ষ্যটি থেকে যেন বিচ্যুত না হতে হয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)