এক, পরিস্রুত পানীয় জল প্রতি বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়া, এবং দুই, নদীর জলদূষণ যে সরকার ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সাম্প্রতিক দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন এই দু’টি সত্যই স্পষ্ট করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের অবশ্য এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। বিধানসভা নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়লেও সুজলা রাজ্যটির পানীয় জলের পরিস্থিতি এখনও অসহনীয় হয়ে ওঠেনি, যদিও তার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। জেলাগুলিতে তো বটেই, কলকাতার মতো গঙ্গা-পার্শ্ববর্তী শহরেও যে দৈনন্দিন ব্যবহারের জলের অভাব নাগরিকজীবনের অন্যতম সমস্যা হয়ে উঠতে পারে, বিশেষজ্ঞরা বহু দিন ধরেই সতর্ক করছেন। কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে যেমন প্রতি গ্রীষ্মে জলসঙ্কট দেখা দিচ্ছে, ঠিক তেমনই অভিযোগ উঠছে পানীয় জলে ক্ষতিকর ব্যাক্টিরিয়ার উপস্থিতির। সম্প্রতি কলকাতা পুরসভার ১০৯ নম্বর ওয়র্ডে একটি জলাধারে ই-কোলাই ব্যাক্টিরিয়ার উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে, যে ব্যাক্টিরিয়াকে পেটের নানা সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে।
যে আবাসনের জলাধারে ক্ষতিকর ব্যাক্টিরিয়ার সন্ধান মিলেছে, সেখানে পুরসভা জল সরবরাহ করে না। কিন্তু এই সংবাদ স্বস্তি দেয় না। কারণ, পুরসভার পানীয় জলের নমুনার হালও উদ্বেগের। পানীয় জলে সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র উপায় নিয়মিত জল পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। সেই কাজটি করে কলকাতা পুরসভার খাদ্য সুরক্ষা বিভাগ। তাদের সাহায্য করে জল সরবরাহ এবং স্বাস্থ্য বিভাগ। এদের উপরেই ন্যস্ত শহরের প্রায় কুড়ি হাজার জলের কল, পলতা, গার্ডেনরিচের জল প্রকল্প, এবং বিভিন্ন বুস্টার পাম্পিং স্টেশনের জলের নমুনা পরীক্ষার ভার। অথচ, এই বিপুল কাজের জন্য ‘ওয়াটার অ্যানালিস্ট’ রয়েছেন মাত্র ন’জন। সুতরাং, নিয়মিত জল পরীক্ষার কাজটি কত দূর ‘গুরুত্ব’ পাচ্ছে পুরসভার কাছে, অনুমানে কষ্ট হয় না। তদুপরি, আবাসনগুলির জল পরীক্ষা করানোর দায়িত্ব আবাসন কর্তৃপক্ষের। তাতে ১৮০০ টাকা ফি দিয়ে পুরসভার কাছে আবেদন জানাতে হয়। বলা বাহুল্য, আবাসন কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও সক্রিয়তার উপর নির্ভরশীল এই কাজ সমস্ত আবাসনে একই গুরুত্ব দিয়ে সম্পন্ন হয় না। সাধারণত বাসিন্দারা অসুস্থ হলে জল পরীক্ষার উদ্যোগ করা হয়, অথচ তিন-চার মাস অন্তর পরীক্ষা করাই হল নিয়ম।
জল-দুর্গতির অন্য নিদর্শনও সুপ্রচুর। কলকাতার একাধিক অঞ্চলে, বিশেষত দক্ষিণ কলকাতায় যথেচ্ছ আইন বহির্ভূত ভাবে ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ায় জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। যে জায়গায় পাইপলাইনে পরিস্রুত জল পৌঁছয়নি, বা কম পৌঁছেছে, সেখানে বাসিন্দারা অনেকাংশে ভূগর্ভস্থ জলের উপরেই নির্ভরশীল। এ দিকে মানবশরীরে আর্সেনিক প্রবেশের পরিণতি ভয়াবহ। পরিস্রুত জলের অভাবে খাস কলকাতায় বহু স্থানে বোতলবন্দি জল খাওয়ার প্রবণতাও দেখা গিয়েছে। কিন্তু সেখানেও নজরদারির অভাবে ভূগর্ভের জল তুলেই অপরিষ্কার জারে সরবরাহ করার অভিযোগ। পরিস্রুত পানীয় জল কিন্তু নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। অপর্যাপ্ত কর্মী-সংখ্যা, পরিকাঠামো নিয়ে পুর-প্রশাসন সেই অধিকারের কদর কতটুকু করছে? পরিস্রুত জলের জন্য লড়াই চালানোই কি তবে কলকাতাবাসীর ভবিষ্যৎ?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)