বছর-শেষের উত্তেজনায় এই সত্যটি খানিক ঢাকা পড়ে যেতে পারে— আজ ফুরোতে চলেছে এই শতাব্দীরও এক-চতুর্থাংশ। পঁচিশ বছর খুব বড় সময় নয়, মহাকালের বিচারে কিছুই নয়, কিন্তু একুশ শতক বলেই এই সময়খণ্ডকে ফিরে দেখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত: আজ যা-কিছু আমাদের জীবন ও চিন্তাভাবনাকে চালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছে, তার প্রায় কোনও কিছুই এই শতকের শুরুতে ছিল না। মাত্র পঁচিশ বছর আগেও আন্তর্জাল, স্মার্টফোন, সমাজমাধ্যম— প্রযুক্তির এই তিন উপজাত ছিল আমাদের অজানা বা অনায়ত্ত; তাদের গুরুত্ব অনুধাবনেরও প্রশ্ন ছিল না। পঁচিশ বছর পর, এই ত্রয়ীর অস্তিত্ব ছাড়া আজ ব্যক্তি থেকে সমষ্টির কোনও স্তরেই জীবন চলে না, এমনকি তার কল্পনাও নয়। যাকে চোখে দেখা দূরস্থান, যার দু’কলম চিঠি পেতে পেরোতে হত অন্তহীন অপেক্ষার প্রহর, এখন তাকে অহরহ দেখা, শোনা, এমনকি তার গতিবিধি পর্যন্ত নজরে রাখা চলে। হাতে গুনে কয়েক মিনিটের মধ্যে দোরগোড়ায় হাজির হচ্ছে বাজার-সওদা, যানবাহন: এই শতকের শুরুতেও কি কেউ এমন কাণ্ড ভাবতে পেরেছিল?
যোগাযোগ ও পরিবহণ— মানবজীবনের দুই মৌল চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা আমূল পাল্টে দিয়েছে প্রযুক্তি, এবং তা হয়েছে চোখের সামনে, গত পঁচিশ বছরেই। তদুপরি সমাজমাধ্যমের আবির্ভাব বদলে দিয়েছে মানুষের সঙ্গে সহমানুষ, সমাজ, রাষ্ট্রের সমীকরণ: প্রযুক্তিজাত কোনও জনসংযোগ-ব্যবস্থা যে এ কাজ করতে পারে তা অভাবনীয়। প্রযুক্তি-ইতিহাসবিদরা বলছেন, বিশ শতক শুরুর পঁচিশ বছরও ছিল তার অতীতের নিরিখে বৈপ্লবিক: বিজ্ঞানে আপেক্ষিকতাবাদ ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবির্ভাব পাল্টে দিয়েছিল বিশ্বকে দেখার চোখ, টিকা-প্রতিষেধকের আবিষ্কার রুখে দিয়েছিল যক্ষ্মার মতো ‘মারণ’ রোগকে, প্রযুক্তিক্ষেত্রে রেডিয়ো ও বিমানের হাত ধরে বদলে গিয়েছিল যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা। রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতিতে এসেছিল অভূতপূর্ব পরিবর্তন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে প্রাচীন রাষ্ট্রশক্তি ও মানচিত্রের পুনর্বিন্যাস, রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্ভব; পাশাপাশি শিল্পে সাহিত্যে সঙ্গীতে পোশাকে আধুনিকতাবাদের পালে হাওয়া জুগিয়েছিল ওই পঁচিশ বছরের সমান্তরাল প্রযুক্তি-বিপ্লবও।
মানুষের জীবন ও ভাবনার ধরন পাল্টে দিয়েছে, একুশ শতকের প্রথম পঁচিশ বছরে এমন ঘটনা অন্তত দু’টি: একেবারে শুরুতেই ঘটে যাওয়া ‘৯/১১’, আর শেষ দিকের কোভিড-অতিমারি। খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট হবে, দু’টি ক্ষেত্রেই বিরাট রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের পাশাপাশি, পাল্টে গেছে প্রযুক্তির গতিপ্রকৃতি। প্রথম ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও নজরদারির কাজ রাষ্ট্র আঁটসাঁট করেছে প্রযুক্তির অস্ত্রে, দ্বিতীয় ঘটনাটির পর গত মাত্র কয়েক বছরে খুলে গেছে অযুত সম্ভাবনার দ্বার, এআই-এর হাত ধরে। সমাজমাধ্যমের যদি বা কোনও স্থবিরতা কল্পনাও করা যায়, এআই-প্রযুক্তির উড়ান সবে শুরু। প্রযুক্তি-পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আগামী পঁচিশ বছর অর্থাৎ ২০২৬-৫০ সময়কাল হবে এজিআই (আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স) ও এএসআই (আর্টিফিশিয়াল সুপারইন্টেলিজেন্স)-এর বিস্তারকাল: মানুষের স্তরের বোধবুদ্ধি অর্জন করে কৃত্রিম মেধার ক্রমে মানুষকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার কেরামতি দেখবে মানুষ নিজেই। এই বৎসরান্ত— সেই অর্থে এক নতুন কালপর্বেরও শুরু।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)