Advertisement
১৩ মে ২০২৪
West Bengal Weather

অগ্নিবলয়

চৈত্রের মধ্যপর্ব থেকেই বঙ্গভূমি দারুণ অগ্নিবাণে জ্বলছে। গ্রীষ্মকালে আবহাওয়ার উত্তাপ বাড়বে, স্বাভাবিক।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:১৬
Share: Save:

চেরাপুঞ্জির থেকে/ একখানি মেঘ ধার দিতে পার গোবি সাহারার বুকে?— গত শতাব্দীর কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘ঘুমের ঘোরে’ কবিতার এই প্রশ্ন যে আসলে একটি চ্যালেঞ্জ, সে-কথা বলে দেওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু, বহু-উদ্ধৃত এই স্পর্ধিত প্রশ্নটি যে স্বয়ং সূর্যের উদ্দেশেই ছুড়ে দিয়েছিলেন অধুনা-বিস্মৃত এই কবি, তা হয়তো অনেকেই মনে রাখেননি। আজ, এই একুশ শতকের তৃতীয় দশকে হাজির থাকলে তিনি সবিস্ময়ে এবং সভয়ে দেখতে পেতেন যে ‘কিরণ-ঝাঁটার হিরণ-কাঠিতে কেন চোখে মার খোঁচা’ গোছের মৃদুমন্দ অভিযোগের তোয়াক্কা না করে সূর্যদেব তাঁর চ্যালেঞ্জটিকে বেমালুম উল্টে নিয়েছেন: গোবি সাহারার বুক থেকে অগ্নিবলয়কে তুলে এনে ফেলেছেন তাঁর সুজলা শ্যামলা জন্মভূমির বুকে। চৈত্রের মধ্যপর্ব থেকেই বঙ্গভূমি দারুণ অগ্নিবাণে জ্বলছে। গ্রীষ্মকালে আবহাওয়ার উত্তাপ বাড়বে, স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া রাজস্থানের থেকে বেশি তপ্ত হয়ে উঠবে, এই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলার কোনও উপায় নেই। এপ্রিল শেষ হওয়ার আগেই রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছে, শুক্রবার কলাইকুন্ডায় উত্তাপ অভূতপূর্ব ৪৪.৭ ডিগ্রি; নিম্নবঙ্গের গাঙ্গেয় উপত্যকার বাতাসেও জলীয় বাষ্পের পরিচিত স্পর্শ নেই, তার বদলে মরুপ্রদেশের প্রচণ্ড শুষ্কতায় জলাশয়, জমি এবং পথচারীর সর্বাঙ্গ দ্রুতনির্জলা, ফুটিফাটা; হাওয়া অফিস অদূর ভবিষ্যতে বৃষ্টি বা আর্দ্রতার আশ্বাস দিতে পারছে না! নীলকণ্ঠ-রূপী ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়: ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে।

ব্রহ্মাণ্ড, বাস্তবিকই, পুড়ছে। রূপকার্থে নয়, বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত তার পুড়ে যাওয়ার হিসাব কষে চলেছেন এবং ক্রমাগত ঘোষণা করে চলেছেন বিশ্ব উষ্ণায়ন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর দুঃসংবাদ। এই গ্রহে এর আগে, অন্তত গত পঞ্চাশ কোটি বছরের মধ্যে, পাঁচ বার বড় রকমের ‘এক্সটিংশন’ বা মহাপ্রলয় ঘটেছে, যে প্রলয়ে অতি অল্প সময়ের অবকাশে ধ্বংস হয় প্রাণিকুল-সহ প্রকৃতির এক বিরাট অংশ। কিন্তু সেই ধ্বংসে গ্রহবাসীদের প্রত্যক্ষ বা সচেতন কোনও ভূমিকা ছিল না— যেমন, সাড়ে ছ’কোটি বছর আগেকার পঞ্চম মহাপ্রলয়ে বিলুপ্ত ডাইনোসররা ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার। কিন্তু গত এক দশকের মধ্যে যে ষষ্ঠ ‘এক্সটিংশন’-এর আসন্ন বিভীষিকার চেতাবনি ক্রমশই বিরাট আকার ধারণ করছে, সেই প্রলয়ের পিছনে প্রধান দায়িত্ব এই পৃথিবীর একটি এবং একটা মাত্র প্রজাতির, তার নাম মানুষ। দীর্ঘ দিন ধরে প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যতের কিছুমাত্র পরোয়া না করে এক দিকে তার সমস্ত সম্পদ যথেচ্ছ ভোগ করার ও অন্য দিকে সেই ভোগ থেকে সঞ্জাত উচ্ছিষ্ট ও আবর্জনা তার মাটিতে, জলে ও হাওয়ায় ছুড়ে ফেলার যে অতুল এবং অ-পূর্ব কীর্তি মানুষ চালিয়ে এসেছে, তার ফলে প্রকৃতি-পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। জলবায়ু পরিবর্তন তারই পরিণাম, বিশ্বপৃথিবী ক্রমাগত অস্বাভাবিক উত্তপ্ত হতে থাকার ঘটনা সেই পরিণামের অন্যতম প্রধান ও প্রকট রূপ। এই মুহূর্তে যে অ-স্বাভাবিক উত্তাপে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরা আক্ষরিক অর্থে তীব্র যন্ত্রণা ও তীব্রতর বিপদের সম্মুখীন, তা ওই বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের অঙ্গ। ব্রহ্মাণ্ড পুড়লে ঘরও বাঁচবে না।

অথচ, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে যে ধুন্ধুমার নির্বাচনী প্রচার চলেছে, নানা মাপের নায়কনায়িকারা প্রবল বিক্রমে পরস্পরের উদ্দেশে চিৎকার করে চলেছেন, গালিগালাজ, কুৎসা এবং রকমারি মিথ্যাভাষণের দাপটে নাগরিকের কান ও মন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, সেই বিপুল শোরগোলে কারও মুখে কোথাও প্রকৃতি-পরিবেশের এই ভয়াবহ সঙ্কট নিয়ে কোনও কথা শোনা যায় না, ব্যতিক্রমী কোনও বক্তা যদি বা এই বিষয়ে দুই-একটি বাক্য খরচ করেন, অলীক কুনাট্য রঙ্গের বিপুল তরঙ্গে তা নিমেষে হারিয়ে যায়। অনেক দিন আগে দেশের অগ্নিগর্ভ রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী অশোক রুদ্র লিখেছিলেন ‘আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক’-এর কথা। এই মুহূর্তে পরিবেশের হাল আক্ষরিক অর্থে আগ্নেয়গিরির সঙ্গে তুলনীয়— প্রতি দিন আকাশ থেকে অবিরত লাভাবর্ষণ চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র তথা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যাঁদের হাতে, তাঁদের এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র তাপ-উত্তাপ নেই। আর নাগরিক সমাজ? তার অবস্থাও তথা এব চ। সর্বনাশের কিনারায় দাঁড়িয়েও এই অনন্ত ঔদাসীন্যের থেকে বড় আশ্চর্য আর কী হতে পারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rajasthan Desert Heatwave
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE