আমাদের সন্তানদের মুখের ক্ষতচিহ্ন/ খুঁজে বেড়াবে তোমাদের। আমাদের শিশুদের কাটা-যাওয়া পা/ ধাওয়া করবে তোমাদের পিছন পিছন।” কবিতা তো নয়, যেন অভিশাপ। বত্রিশ বছরের কবি মোসাব আবু তোহা জন্মেছিলেন গাজ়ার এক শরণার্থী শিবিরে। নিউইয়র্কার পত্রিকায় প্রকাশিত গাজ়ার জীবনের উপরে তাঁর নিবন্ধাবলি জিতেছে পুলিৎজ়ার পুরস্কার। তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই, ধ্বনির অরণ্য (দ্য ফরেস্ট অব নয়েজ়) আরও এক বার দেখায়, ধ্বস্ত শহর, ছিন্ন দেহের সরাসরি সম্প্রচারের চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে সামান্য কয়েক লাইনের একটি কবিতা। আকাশ থেকে উল্কার মতো আছড়ে পড়ছে ক্ষেপণাস্ত্র, বিস্ফোরকে নিমেষে ধূলিসাৎ হচ্ছে সার সার বহুতল, এ সব দৃশ্য খানিকটা কি উত্তেজনা তৈরি করে না দর্শকের মনে? সে হল দূর থেকে খেলা দেখার উল্লাস। কবিতা এক ঝটকায় ঘুচিয়ে দেয় সেই দূরত্ব। যুদ্ধের উন্মত্ততা মাথায় নিয়ে যাঁরা বাঁচছেন, তাঁদের পাশে দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠককে। যাদের মাথায় আকাশ থেকে আছড়ে পড়ে মৃত্যু, তাদের দৈনন্দিনের বোধ বেঁকেচুরে কী অদ্ভুত, অপরিচিত আকার নেয়, তার আন্দাজ তৈরি করে। “আমি ঘরের দরজা খুলে রাখি, যাতে আমার বইয়ের সব শব্দ/ তাদের শিরোনাম, লেখক আর প্রকাশকের নাম/ পালাতে পারে বোমার শব্দ শুনলেই।” মোসাব পেশায় গ্রন্থাগারিক। অতি সাধারণ কিছু কথা, অথচ অসামান্য তার অভিঘাত— যুগে যুগে এই হল যুদ্ধের কবিতার বৈশিষ্ট্য। বাস্তবের বীভৎসতা, যন্ত্রণা, যখন কল্পনাকে বহুগুণ ছাড়িয়ে যায়, যখন মন সেই অপরিমিত ধ্বংসের কিনারা খুঁজে পায় না, তখন বুক-চেরা বিলাপটুকু থেকে যায় কাব্য হয়ে।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার অন্যতম শহর উর বিধ্বস্ত হয়েছিল বহিরাগতদের হাতে। জিশুর জন্মের দু’হাজার বছর আগের রচনা ‘উরের বিলাপ’ এক দেবীর বয়ানে লেখা, যিনি শত্রুর আক্রমণকে দেখছেন বন্যার উচ্ছ্বাস, ঝড়ের তাণ্ডবের মতো— এমন ঝড়, যা ধ্বংস করেছে ভেড়ার খোঁয়াড়। ইতিহাসবিদদের ব্যাখ্যা, ‘ভেড়ার আশ্রয়’ ধ্বংস আসলে অগণিত মানুষের আশ্রয়স্থল নগরের পতনের প্রতীক। মহাভারত অবশ্য এমন উপমার আড়াল রাখেনি। উদ্যোগ পর্ব থেকে সৌপ্তিক পর্ব পর্যন্ত যা বীর্যশৌর্যের উন্মাদনা, অস্ত্রের ঝন-ঝনাৎকার, স্ত্রীপর্বে অন্তর্হিত— সেখানে শুধু প্রেতভূমির বীভৎসতা, শোকের আগুন। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা সম্পূর্ণ প্রকট করতেই যেন মহাভারতের কবি তা দেখাচ্ছেন এক মায়ের চোখ দিয়ে— যে কেবল নিহত পুত্রদের দেখছে না, দেখছে ভয়ে-দুঃখে উন্মত্ত পুত্রবধূদের। “হায়, কর্ণের পত্নী জ্ঞানশূন্য হয়ে ভূতলে পড়ে গিয়েছে, শ্বাপদগণ কর্ণের দেহের অল্পই অবশিষ্ট রেখেছে। ...হা হা, ওই দেখ, দুঃশলা তার পতির মস্তক না পেয়ে চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।” মহাযুদ্ধের চেয়েও যেন ভয়াবহ ‘রুদ্রের ক্রীড়াঙ্গণের ন্যায় সেই যুদ্ধভূমি’ আলিঙ্গন করে মেয়েদের হাহাকার। ধর্ম কী, বীর কে, জীবনের মূল্য কিসে, কোনটা সর্বাধিক প্রার্থনীয়, যুদ্ধ-কাব্য দাঁড় করিয়ে দেয় এ সব প্রশ্নের সামনে।
প্রাচীন কাব্যে এই অন্তহীন শোকগাথার মধ্যেও ঝলসে উঠত মানব-সম্পর্কের দ্যুতি। পাণ্ডবরা সরোদনে কৌরবদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন, ক্ষমাপ্রার্থনা করেন ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারীর কাছে। হোমারের ইলিয়ড কাব্যে ট্রয়ের রাজা বৃদ্ধ প্রিয়াম পুত্র-হত্যাকারী আকিলিসের কাছে দীন ভাবে ভিক্ষা চান তাঁর নিহত পুত্র হেক্টরের মৃতদেহ। আধুনিক যুদ্ধ মানুষে-মানুষে সাক্ষাৎ, প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্থান প্রায় শেষ করে এনেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই যুদ্ধ নিয়ে রোমান্সের ধারণাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলেন কবি-যোদ্ধারা। বৃদ্ধ ভিখারির মতো আনত হয়ে, বৃদ্ধার মতো কাশতে কাশতে, জুতোহীন রক্তাক্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সেনারা, গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে ছটফটিয়ে মরছে, নিজের কবিতায় সে ছবি দেখিয়েছিলেন ইংরেজ কবি উইলফ্রেড আওয়েন, পঁচিশ বছর বয়সে যিনি নিহত হন যুদ্ধে। যোদ্ধা কবিরা যেন যুদ্ধের ‘ব্লগার’— যা ঘটছে তা একেবারে চাঁছাছোলা ভাবে তুলে ধরেন সকলের সামনে। আমেরিকার কবি ব্রায়ান টার্নার ইরাক যুদ্ধে লড়াইয়ের (২০০৪) পর কবির স্পর্ধায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন বুলেটকে— যা শুরু করেছ, তা শেষ করো। এই আমার অস্থি, মজ্জা, মাংস— “এখানেই, বুলেট, প্রতি বার শেষ হয় জগতের” (‘হিয়ার, বুলেট’)। কিন্তু অস্থি-মজ্জার বিনাশে তো কবির মৃত্যু হয় না। অনন্ত ফসল-চক্রের মতো শব্দও প্রোথিত হয়, অঙ্কুরিত হয়, ভরা হয় গোলায়। মোসাব লিখছেন, “আমি তুলছিলাম বালতিতে জল/ শিবিরের কুয়ো থেকে/ খুঁজতে শব্দ/ আমার মহাকাব্যের জন্য।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)