এত বাঘ কেন? বইয়ে বাঘের ছবি দেখতে অভ্যস্ত শিশুরা, এবং বড়রাও; সেখানে বাঘ-সংক্রান্ত খবরের এই রমরমা কেন? জ়িনতের বাংলা অভিযান, মৈপীঠের গ্রামরাস্তায় দক্ষিণ রায়ের বারংবার আনাগোনা, ওয়েনাড়ে মানুষখেকোর আবির্ভাব— দেশে ‘বাঘ পড়া’র ঘনঘটার কাছে রোমাঞ্চগল্পও ফিকে। সরকার প্রশ্নটি শুনলে শিশুভোলানো কথা বলে: এ হল প্রোজেক্ট টাইগারের সাফল্যের চিহ্ন। বাঘ বাড়ছে, তাই বাঘের দেখা, বাঘের গল্পও বাড়ছে। সংরক্ষণবিদদের পাল্টা প্রশ্ন— বাড়লেও তারা বনের আড়াল হতে বেরোচ্ছে কেন? এতে প্রমাণিত, ভারতের বাঘসংখ্যা বনগুলির ধারণ ক্ষমতা ও বন দফতরের সহন ক্ষমতার বাইরে। আশঙ্কাটির সাক্ষী পরিসংখ্যান। গত পাঁচ বছরে এক মাসে সর্বাধিক বাঘের মৃত্যুর রেকর্ড গড়েছে ২০২৫-এর জানুয়ারি। ২৪টি রয়্যাল বেঙ্গলের শব মিলেছে বছরের প্রথম মাসে। বাঘসংখ্যা বাড়লে মৃত্যুর পরিসংখ্যানও বাড়বে। বাঘের প্রজনন ঋতু শীতকালে প্রতি বছরই মৃত্যুর হার বাড়ে। বাঘ এলাকা ছেড়ে অন্য জঙ্গলে সঙ্গিনী খোঁজে। সেখানকার বাঘের সঙ্গে লড়াই হয়, এবং তার জেরে বাঘ মারা পড়ে। কুয়াশা-ঢাকা হাইওয়ে, রেলরাস্তায় যানবাহন ভাল না দেখতে পেয়েও বাঘ মারা যায়। তবে উদ্বেগের বিষয়টি হল, বাঘেদের মৃত্যুতে মানব-ঘটিত কারণ বাড়ছে। শীতে রবিশস্যের খেতে বনশূকরকে ঠেকাতে বৈদ্যুতিক বেড়া দেন কৃষকেরা। বাঘ এলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে। কেরলের ওয়েনাড়ে মানুষখেকো বলে চিহ্নিত বাঘটি সমেত ১৪টি মৃত্যুই ঘটেছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে। দু’টি বাঘ চোরাশিকারের বলি, একটি বাঘ স্থানান্তরকরণের পরে মারা গিয়েছে।
মোদ্দা কথা, বন থেকে বেরোনোর কারণে মানুষ ও সভ্যতার সঙ্গে সংঘাতে বাঘ মারা পড়ছে। বস্তুত, জনস্ফীতি ও দারিদ্রের সমস্যায় দীর্ণ দেশে বাঘ বাড়ানোর বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ এটাই। মানুষ ও বাঘকে একযোগে রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। ভারতে বাঘেদের বিচরণভূমির প্রায় ৪৫ শতাংশেই মানুষ থাকে বা তার গতিবিধি আছে। তাই সংরক্ষিত এলাকার বাইরেও বাঘের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ‘মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক’ পশুকে সরাতে হবে তৎক্ষণাৎ। সড়ক, রেলরাস্তাকে উড়ালপুলের মতো উপরে রেখে, নীচে বাঘ চলাচলের নিরাপদ জঙ্গুলে রাস্তা বার করতে হবে। বাস্তুতন্ত্রে বাঘের ভূমিকা, তা বনের স্বাস্থ্যোন্নতির মাধ্যমে কী ভাবে জলবায়ু সমস্যা কমিয়ে প্রকারান্তরে গ্রহকে বাঁচায়— জানাতে হবে অরণ্যবাসী মানুষকে। বন বাড়ানোর জন্য জীবিকা-বাসস্থান হারালে ও বাঘে গবাদি পশু নিলে ক্ষতিপূরণ এবং বাঘের সঙ্গে সহাবস্থানের অর্থনৈতিক সুবিধাগুলির ভাগ দিতে হবে। তবেই বাঘকে শত্রু ভাবা, পিটিয়ে মারা, বিষ দেওয়া কমবে। বৈদ্যুতিক বেড়ার ভোল্টেজ-সীমা নির্দিষ্ট থাক, পশু চমকালেই যথেষ্ট, প্রাণঘাতী যেন না হয়। এই বহু আলোচিত উদ্যোগগুলির প্রয়োগ বিষয়ে অধিকাংশ রাজ্যের বন দফতরই মৌন। সম্প্রতি শোরগোল উঠেছে বাঁধ নির্মাণের জন্য রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্কের অনেকটা জলতলে ডুববে। বিকল্প বিচরণভূমির ব্যবস্থা ব্যতিরেকে এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে মানুষেরই সঙ্কট। বাঘ এলাকা হারাবে, লোকালয়ে যাবে, ঘাত-প্রতিঘাত বাড়বে। আসলে, শুধু সংখ্যাই প্রোজেক্ট টাইগারের সাফল্যের মানদণ্ড নয়। বিশ্ব দরবারে ভারতের প্রকৃত শক্তি তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন বাঘ সংরক্ষণও হবে, দরিদ্র সঙ্কটক্লিষ্ট ভারতবাসীর জীবনে মেঘও কাটবে: ‘চিরকালীন ভালবাসার বাঘ বেরোবে বনে।’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)