Advertisement
E-Paper

উৎসবময় রাঢ়বঙ্গের পাহাড়পুর গ্রাম

পাহাড়পুর বেশ প্রাচীন গ্রাম। এখানে জৈন ধর্মের আদি তীর্থঙ্কর ঋষভ দেবের মূর্তির পুজো হয়ে আসছে। কথিত, পত্তহারী নামে এক জৈন সাধক বাস করতেন। একটি জৈন পীঠ গড়ে উঠেছিল এখানে। তাঁরা পবনহারি অর্থাৎ পবন আহারি বা বায়ুভুক, তার থেকেই পবনাহারিপুর এবং ক্রমাণ্বয়ে পওহারিপুর, পত্তহারপুর আর তারই অপভ্রংশ হয়ে নাম হয়েছে পাহাড়পুর। লিখলেন সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায়।গ্রামের উত্তরে অর্থাৎ ‘নামপাড়া’য় মহান্তদের ‘রাধামোহন’ ঠাকুরের পুজো হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে।

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ১০:৩২
জৈন ধর্মের বিশালাক্ষীর শিলা মূর্তি।

জৈন ধর্মের বিশালাক্ষীর শিলা মূর্তি।

সৃষ্টি, শক্তির মূল উৎস গ্রাম। গ্রামেই যেন সংস্কৃতির শিকড়। গ্রামই যেন শিল্প ও শিক্ষার আকর। গ্রামগঞ্জই এক একটি দেশ রাজ্যের প্রাণ। যতই শহরমুখী হোক আমাদের ইতিহাস গ্রাম, ছোট ছোট বন-জঙ্গল, সেচের নদী, নালা। সমাজ গড়ার সেই বাঁধনকে অস্বাকার করার জো নেই। খড়-মাটি, পল্লি-প্রকৃতি, গোষ্ঠী-পরিবার গ্রামকে কেন্দ্র করেই নির্মিত শত সহস্র বাঙালির মুখ। সেই সব মুখের দিকে তাকালে দূর–সুদূর অতীতের গান গল্প ভেসে আসে বহমান জীবনের স্রোতে।

সেরকমই বীরভূমের আমোদপুর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে বক্রেশ্বর নদীর তীরে পাহাড়পুর গ্রাম। যার শরীর ভরা ডাঙা- ডহর, গাছ পালার সুগন্ধ। বনকুল, আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, বাবলার ফুরফুরে হাওয়ায় কত আশীর্বাদের মাঠ! অধিকাংশই কৃষি নির্ভর এই গ্রামের জনজীবন উৎসাহিত হয়ে চলেছে আজকের নানারকম বৃত্তি মূলক শিক্ষা নিয়ে।

পাড়ুই থানার অন্তর্গত হাজার চারেক জনসংখ্যার গ্রাম পাহাড়পুর। যেখানে হিন্দু, আদিবাসী, মুসলমান, খৃস্টান সব মিলিয়ে মিশিয়ে বাঙালি জীবনের স্রোতধারা। ঠাকুরবাড়ি, মুখার্জীবাড়ি, ভট্টাচার্যপাড়া, মহন্তপাড়া, মালপাড়া, নামপাড়া, সাহাপাড়া, বাউরিপাড়া, ডাঙালপাড়া ইত্যাদি মিলে হাত ধরাধরি করে বসবাস সব সম্প্রদায়ের মানুষের। উৎসব আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন এই গ্রামের মূল মন্ত্র। পাহাড়পুর বেশ প্রাচীন গ্রাম। এখানে জৈন ধর্মের আদি তীর্থঙ্কর ঋষভ দেবের মূর্তির পুজো হয়ে আসছে। কথিত, পত্তহারী নামে এক জৈন সাধক বাস করতেন। একটি জৈন পীঠ গড়ে উঠেছিল এখানে। তাঁরা পবনহারি অর্থাৎ পবন আহারি বা বায়ুভুক, তার থেকেই পবনাহারিপুর এবং ক্রমাণ্বয়ে পওহারিপুর, পত্তহারপুর আর তারই অপভ্রংশ হয়ে নাম হয়েছে পাহাড়পুর। এখানকার বাসিন্দারা সকলে জৈন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন ছিলেন। ঋষভ-এর মূর্তি তাঁদের প্রতীক, বিশালাক্ষীর পুজো করতেন যা আজও পুজো হচ্ছে পাহাড়পুর রায় পাড়াতে। বিশালাক্ষীর থানে (স্থান) নবপত্রিকার দুর্গা পূজা হয়ে আসছে ধুমধাম করে। আবার, অন্যদিকে মালপাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষদের বসবাসের জন্যও পাহাড়পুর নাম হতে পারে বলে মনে করছেন গ্রামের সোমেশচন্দ্র ঠাকুর, কৃষ্ণময় মুখোপাধ্যায়, তমালকৃষ্ণ মহন্তরা। বেশ প্রাচীন গ্রাম এই পাহাড়পুর। তার চিহ্ন স্বরূপ ষড়াক সম্প্রদায়ের মানুষের বাস ছিল এখানে। গ্রামের দক্ষিণে এখনও ‘ষড়কগোড়ে’ নামে পুকুর আছে। এমনিতেই বীরভূমের নানা স্থানে মুনি ঋষিদের আশ্রম ছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল।

বিমানবিহারী মজুমদারের শ্রী চৈতন্য চরিতের উপাদান বইতেও পাওয়া যাচ্ছে পাহাড়পুর গ্রামের নামটি। তাতে উল্লেখ আছে, সেখানে বহু বৈষ্ণব ভক্ত মানুষের বসবাস ছিল একসময়ে। সেই প্রাচীন কালেই পাহাড়পুর জঙ্গল মহলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখনকার রাজনগরের রাজা আলিনকী খাঁ-এর নায়েব আঁটুরাম। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, এই আলিনকী খাঁকে নিয়ে বেশ কিছু গাথা আছে, তার মধ্যে একটি, ‘আলিনকী বাহাদুর পাগড়ীমে বাঁধে তলোয়ার / এক ঘড়িমে লুঠ লিয়া কলকেত্তা বাজার।’ প্রবাদ আছে, রাজনগরের যুবরাজ আলিনকী খাঁ কিছু দিন নবাব সিরাজউদ্দোলার অধীনে কাজ করেছিলেন । নবাবের কলকাতা আক্রমণের সময় আলিনকী খাঁ-ও তাঁর সঙ্গে ছিলেন এবং সেই যুদ্ধে শৌর্য দেখিয়েছিলেন। খুশি হয়েছিলেন সিরাজ। সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বই থেকে জানা যায়, ‘আলিপুর’ তাঁর নামানুসারে হয়েছে। বারো মাসের তেরো পার্বণ লেগেই আছে পাহাড়পুর গ্রামে। রাস, দশহরা, নুনপালা ও দুর্গা পুজো, রবীন্দ্র জয়ন্তী, কুল– মচ্ছব জন্মাষ্টমী, ধরম-ঠাকুর এরকম কত কী !

কার্তিক-অগ্রহায়ন মাসের রাস পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে মহা সমারোহ। প্রায় পাঁচ বছর ধরে রাধা-কৃষ্ণ রাধা-বল্লভ নামে পুজো পেয়ে আসছেন। সেই উপলক্ষে কীর্তন, যাত্রাপালা, আরও কত রকমের গান বাজনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। পাহাড়পুরের ঠাকুর পরিবারই এসবের আয়োজন করে থাকেন। তাছাড়াও রাধা-বল্লভ পাট বাড়িতে পঞ্চম দোল, গৌর এসব তো বহু বছরের পুরনো। এসব বহু প্রাচীন কাল থেকেই এসেছে পুজোকে কেন্দ্র করেই। মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি তারই চিহ্ন স্বরূপ। এই রাধাবল্লভ রামকানাই ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে লোকশ্রুতি।

তেমনি গ্রামের উত্তরে অর্থাৎ ‘নামপাড়া’য় মহান্তদের ‘রাধামোহন’ ঠাকুরের পুজো হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। ১৬৫০ খৃস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে পুরন্দর পণ্ডিত ও ব্রজমোহন মহন্ত পাহাড়পুরের এই রাধামোহন প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। এখানেও কীর্তনপালা, দোল, জন্মাষ্টমী, কুল-মচ্ছব হয়ে থাকে। এখানে কবি চণ্ডিদাস-এর পদ যেন আকাশে বাতাসে মুখরিত হয়, ‘কিবা রূপে কিবা গুণে মন মোর বাঁধে/ মুখেতে না সরে বাণী প্রাণ মোর কাঁদে।’

পিতা প্রপিতামহদেরই ভূমি, যেখানে এককালে জমিদারী ছিল — সেকালের বিহারী লাল মুখোপাধ্যায়ের আমল থেকে। বর্ধমানের মহারাজা ও কান্দির বিমল সিংহের অধীনে। কংগ্রেস আমলে শক্তিপদ মুখোপাধ্যায় এই অঞ্চলের ইউনিয়নের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। সেসময় তাঁর বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন পন্ডিত এবং সংস্কৃতি সম্পন্ন রামপদ মহন্ত, পশুপতি সাহা ও সৌরেশচন্দ্র ঠাকুরের মতো এ গ্রামের বেশ কিছু গুণী মানুষ।

জৈষ্ঠ্য–আষাঢ় মাসে পাহাড়পুরে মনসা পুজো উপলক্ষে দশহরা হয়। কয়েক’শ বছর থেকে চলে আসছে এই রীতি। প্রাচীন কাল থেকেই সমাজে চলে আসছে নানা ব্রত পালন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু ব্রতের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যে। যেখানে মনসাদেবীকে কেন্দ্র করে মনসামঙ্গল কাব্য রচিত হয়। প্রতিবছর এখানে গাওয়া হয় সেই গান। মনসা ব্রতেরই রূপান্তরিত সংস্করণ হচ্ছে দশহরা। বড়মা, ছোটমা নামে দুই মনসার পুজো হয়। শোনা যায় কালা পাহাড়ের আক্রমণে নিক্ষিপ্ত এই টুকরো দুটির পুজো করছেন আজকের দেবাংশি পরিবার। দশহরা উপলক্ষে তিন দিনের বিশেষ সমারোহের আয়োজন করে আসছেন জয়দেব দেবাংশিদের পরিবার। মহা পুজোকে কেন্দ্র করে তিন চার দিনের মেলা বসে। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন আনন্দে মুখরিত থাকে। এই লোকপ্রিয় অনুষ্ঠানটির জন্য পাহাড়পুর এক লোকায়ত প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে। ওই দিনই ডাঙাল পাড়ায় খুবই জাকজমক করে গাছমঙ্গলার উৎসব হয়। নানারকম শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তেমনই আদিবাসী মানুষদের জমায়েত চোখে পড়ার মতো। এই দশহরা মেলা প্রাঙ্গণ আদিবাসী সাঁওতাল মানুষদের একটি মেলবন্ধনের দিন বলা যায়। সাড়া গ্রাম হইহই করে এই ক’দিন !

প্রচার বিমুখ অনেক মানুষ ছিলেন এ গ্রামে। এখনকার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষার আদানপ্রদানও ছিল না। অথচ ১৯৬০-৬৫তে ইংরেজি, ফরাসি, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় দক্ষ মানুষেরা ছিলেন। ভাবলে আজ অবাক লাগে। রবীন্দ্র সংগীতে বা অন্যান্য গানে ধনঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের নাম আমোদপুর–কুচুইঘাটা হয়ে পাঁচ গাঁয়ে ঘুরতো। সুগার মিলের বাঁশির আওয়াজে আমাদের দিন হতো। সেই বাঁশি যেন এখনও ডাকে। সে সব ১৯৭০, ৮০, ৯০-এর চলে যাওয়া দিন দুপুরগুলি। ধুলোবালির রাস্তায় সাইকেল — সেই সব সময়ের চিত্রপট আর কী। এই গ্রামেই মানুষ বাচিক শিল্পী দেবেশ ঠাকুর। অন্যদিকে, এক সময়ে যাত্রার নাম করা শিল্পী সুনীল দাস বৈরাগ্য, কৃষ্ণময় মুখোপাধ্যায়, জয়দেব দেবাংশি, বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুকুমার মিশ্র, মহাদেব রায়, মহাদেব মিশ্র এবং ঠাকুর বাড়ির কেউ কেউ অভিনয়ের অন্য এক মাত্রা রেখে গিয়েছেন। একদা ‘পাহাড়পুর নাট্য ভারতী’ এবং সৌরেশচন্দ্র ঠাকুর পরিচালিত ‘পল্লীশ্রী যাত্রা সমাজ’ মাতিয়ে রেখেছিল। যে সময়ে গ্রাম জীবনের এক মাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল যাত্রা, নাটক। রায়বেঁশের জন্য ধরম বাগদি, কবি-গানে আদিত্য বাগদি, লোকায়ত সঙ্গীতে তিনকড়ি বাগদি - এঁরা জেলার মান রেখেছেন। পাহাড়পুর ধারাবাহিক শিক্ষাকেন্দ্রের নব স্বাক্ষর পড়ুয়ারা কলকাতার রবীন্দ্র সদনে নাটক মঞ্চস্থ করেছে। বিধায়ক নীলাবতি সাহাও এই গ্রামেরই মেয়ে।

সন্ন্যাসী বায়েন, বিজয় বায়েন, মলিন্দ্র বায়েন, গৌর বায়েন, অষ্ট বায়েনদের ঢাক ঢোলের বাজনা এখন কত শহরে পরিচিত। গেড়া বায়েনের নহবত, কোথাও ক্ষুদিরাম বায়েনের সানাই কতো সুরে সুরে এ গ্রামেরই কথা বলে।

(লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব)

Birbhum Parui Jainism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy