Advertisement
১৭ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

নিরানব্বই ও এক

অদম্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর শাসকের রাগ আজিকার বিষয় নহে। পশ্চিমবঙ্গের নিজস্বও নহে।

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৮ ০০:৩৪
Share: Save:

নিরানব্বইয়ের গেরো হইতে পশ্চিমবঙ্গের নিস্তার নাই। ২০১২ সালে, তাঁহার সরকারের এক বৎসর পূর্তি উপলক্ষে ‘৯৯% কাজ সারিয়া ফেলা গিয়াছে’ বলিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাস্যরসের উদ্রেক করিয়াছিলেন। কিন্তু, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায় হাসাও মুশকিল। তিনি ঘোষণা করিয়াছেন, রাজ্যের নিরানব্বইটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাল, মন্দ শুধু যাদবপুর। শুনিয়া যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা তো আঁতকাইয়া উঠিবে বটেই, অন্য কলেজের ‘তাজা ছেলে’রাও গালে হাত দিয়া ভাবিতে বসিবে। শিক্ষামন্ত্রী নিশ্চয়ই উচ্চশিক্ষার মাপকাঠি ব্যবহার করিয়া এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হন নাই। নচেৎ, তিনি জানিতেন, যাদবপুর শুধু পশ্চিমবঙ্গের নহে, গোটা দেশেরই অগ্রগণ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গোলমালের মাপকাঠিতেও যাদবপুর বহু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পিছাইয়া আছে। বেশি দূরে যাইবার প্রয়োজন নাই— কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রছাত্রীরা যে পরিমাণ অশান্তি করে, যাদবপুরের ছেলেমেয়েরা সে তুলনায় নিতান্তই গোপাল। উচ্চশিক্ষার যাহা অন্যতর মাপকাঠি, অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করিবার ক্ষমতা, তাহাতেও যাদবপুর রাজ্যের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দশ গোল দিবে। সন্দেহ হয়, শিক্ষামন্ত্রী তাহাতেই চটিয়াছেন। হীরকরাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর এই কারণে চটিবার হক আছে। কেননা, উহারা যত বেশি জানে, তত কম মানে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা যখন মনের রং নীল-সাদা করিয়া ফেলিয়াছে, তখন যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয় বেসুরো গাহে, তাহাকে মন্দ মনে হইতেই পারে।

অদম্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর শাসকের রাগ আজিকার বিষয় নহে। পশ্চিমবঙ্গের নিজস্বও নহে। ১৯৬৮-র ফ্রান্স হইতে ২০১৬-র দিল্লি, শাসক সর্বত্রই ছাত্রদের ভয় পাইয়াছে। আক্রমণও করিয়াছে। ইতিহাস সাক্ষী, কখনও শাসকের জয় হয় নাই। পার্থবাবুকে সেই ইতিহাস স্মরণ করাইয়া দিবার পূর্বে অবশ্য বর্তমানের কথা বলিতে হইবে। তিনি ঘোষণা করিয়াছেন, যাদবপুরের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া ভিন্ন আর সবই করে। কথাটি তিনি জানিলেন কোন গোপন সূত্রে? বিভিন্ন আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিং-এ ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে যাদবপুরের স্থান একেবারে উপরের দিকে। ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র‌্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্কও যাদবপুরকে দেশের ষষ্ঠ শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা দিয়াছে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া না করিলে কি এই স্বীকৃতি অর্জন করা সম্ভব? এখনও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় সফলতম ছাত্রছাত্রীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইবার অপেক্ষায় থাকে। পার্থবাবুর মতে যে নিরানব্বইটি জায়গা ভাল, সেগুলির অপেক্ষা যাদবপুরের চাহিদা বহু গুণ। বাজারের এই চাহিদাও কি প্রতিষ্ঠানের গুণমাননিরপেক্ষ হইতে পারে? আক্রমণ করিবার অতি আগ্রহে এক জন তৃণমূল নেতা এই কথাগুলি ভুলিতেই পারেন। কিন্তু, স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীও যদি কথাগুলি ভুলিয়া যান, তবে তাঁহার যোগ্যতা লইয়া প্রশ্ন উঠে, যাদবপুর লইয়া নহে।

শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে পার্থবাবুর দৃশ্যত দ্বৈতসত্তা আছে। এক দিকে তিনি কখনও ভুলেন না যে প্রতিষ্ঠানগুলিকে তিনিই টাকা দেন। অন্য দিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিচার করিতে হইলে যে রাজনৈতিক আনুগত্য মাপকাঠি হইতে পারে না, এ কথাটি তাঁহার স্মরণে থাকে না। এই একটি মাপকাঠিতেই যাদবপুর রাজ্যের আর নিরানব্বইটি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় পিছাইয়া আছে। কিন্তু, তাহা তো শিক্ষামন্ত্রীর বিচার্য নহে। কিন্তু, অনুমান করা চলে, অনধিকার চর্চা তাঁহার পছন্দের বিনোদন। যাদবপুরে অ্যাডমিশন টেস্টের মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি করা হইবে কি না, বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির বিভিন্ন নিয়ম থাকিতে পারে কি না, সব বিষয়েই তিনি অনধিকার চর্চা করিয়া চলিয়াছেন। তবে, নিরানব্বইয়ের সহিত এককে যে মেলানো যায় না, এই কথাটি বুঝিয়া লইলে তিনি ভাল করিবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Political loyalty educational institution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE