Advertisement
E-Paper

আবেগ যেন শুধু পাহাড়েই

সে যা-ই হোক, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের একটা ইতিহাস তো তৈরি হয়েইছে। একশো দশ বছর ব্যাপী এক ইতিহাস। যার মধ্যে অসংখ্য উত্থান-পতনের পরম্পরা আছে।

বিমল লামা

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৭ ১৩:৪২
বিদ্রোহী: নিজেদেরই কষ্ট দিয়ে নিজেদের দাবিতে অটল থাকছেন পাহাড়ের মানুষ। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে অবরুদ্ধ কালিম্প‌ং, ১২ জুলাই। ছবি: পিটিআই

বিদ্রোহী: নিজেদেরই কষ্ট দিয়ে নিজেদের দাবিতে অটল থাকছেন পাহাড়ের মানুষ। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে অবরুদ্ধ কালিম্প‌ং, ১২ জুলাই। ছবি: পিটিআই

গোর্খাল্যান্ডের দাবি উত্থাপনের একশো দশ বছর পূর্তি হল এই বছর। ১৯০৭ সালে হিলমেন’স অ্যাসোসিয়েশনের ইংরেজ সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশের মধ্য দিয়ে যার সূচনা। সেই উপলক্ষে একটা ‘ইভেন্ট’-এর দরকার ছিল হয়তো। কিন্তু পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলো বা তাদের নেতারা কেউ সচেতন ভাবে তেমন উদ্যোগ নেননি। হয়তো হিলমেন’স অ্যাসোসিয়েশনটির আর অস্তিত্ব নেই বলেই। এতেই বোঝা যায় ধারাবাহিকতার অভাব তো আছেই।

কিন্তু ইভেন্ট-এর সূত্রপাতের জন্য প্রয়োজনীয় উপলক্ষ যেন আকাশ থেকে এসে পড়ল পাহাড়ের মানুষের কোলে। অদৃষ্টবাদীরা এর মধ্যে অদৃষ্টের খেলাও দেখে থাকতে পারেন। যাকে বলে নিয়তি। যে সহস্রাধিক প্রাণ বলি হয়েছে দাবি আদায়ের প্রচেষ্টায় এবং যে সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, তাদেরই অতৃপ্ত আত্মার যৌথ শক্তিও দেখে থাকতে পারেন কেউ।

সে যা-ই হোক, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের একটা ইতিহাস তো তৈরি হয়েইছে। একশো দশ বছর ব্যাপী এক ইতিহাস। যার মধ্যে অসংখ্য উত্থান-পতনের পরম্পরা আছে। শুধু তাই না, আছে রীতিমতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একটা পর্ব। কিন্তু পাহাড়ের দিক থেকে দেখলে, পুরোটাই ব্যর্থতা। প্রভূত মূল্য দেওয়ার পরেও শতবর্ষের ইতিহাস মূলত ব্যর্থতারই ইতিহাস।

কালের নিয়মে উলটো পক্ষ বদলে বদলে গেছে। বর্তমান পক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার। তাদের কাছে বিচার্য ইতিহাসের মাত্র একটাই খণ্ডাংশ। শতাংশের হিসাবে প্রায় ছয় শতাংশ ইতিহাস। তার আগে প্রায় চৌত্রিশ শতাংশ ইতিহাসের সাক্ষী থেকে গেছে বামফ্রন্ট সরকার। বিচারে সেটাই সবচেয়ে গুরুভার, কারণ রক্তক্ষয়ী পর্বটি রচিত হয়েছিল সেই সময়কালের মধ্যেই। তারও আগে ছিল কংগ্রেসের দুটো পর্ব, বিধানচন্দ্র রায় আর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বাধীন। আর সূচনায় ছিল উপনিবেশবাদী ইংরেজ সরকার। অর্থাৎ দাবিটা একশো দশ বছর ধরে চললেও অত বছর ধরে আসলে কেউ শোনেনি। যার ভাগে যে খণ্ডাংশ পড়েছে, তারই নিরিখে সে তার বিচার করেছে। এর ফলে দার্জিলিং পরিস্থিতিকে কখনও অখণ্ড এক সামগ্রিকতায় ধরা হয়নি। ধরার চেষ্টা কেউ করেনি।

এ তো গেল শাসকের কথা। বাকি রইল সমতল বাংলার সাধারণ মানুষ। তাঁরা কী ভেবেছেন এত দিন? তাঁদের কাছে বিষয়টা এক ধরনের আবেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যবান কোনও কিছু হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, এই ভাবনাসঞ্জাত আবেগ। আর আবেগের কাছে যুক্তিতর্কের মূল্য কতটুকু, সে সবাই জানে। যুক্তি দিয়ে বাস্তবে মানুষকে কোনও দিন বোঝানো যাবে না, এই আবেগের কোনও যুক্তি নেই। কারণ, দার্জিলিং তাঁদের কাছে বেড়ানোর জায়গা বই আর কিছু নয়। যেমন গ্যাংটক। যেমন পুরী। ওই জায়গা দুটো বাংলার বাইরে বলে বাড়তি কোনও চাপ নেই তাদের নিয়ে। কোনও বাধাও নেই সে সব জায়গায় গিয়ে পর্যটনের পুরো আনন্দ নেওয়ার। হোটেল লিজ নিয়ে ব্যবসা করার। বা, ইচ্ছে করলে সেখানে বসত করার। দার্জিলিঙের আবেগটুকু বাদ দিলে পুরী গ্যাংটকের সঙ্গে তার কোনও ফারাক নেই।

অথচ উলটো একটা ছবিই চিরকাল তুলে ধরা হয়েছে মানুষের সামনে। বলা হয়েছে আবেগটা আসলে পাহাড়ের মানুষেরই। জাতিসত্তার, ভাষার, পরম্পরা ও সংস্কৃতির। এক কথায় আত্মপরিচয়ের। কিন্তু তালিকাবদ্ধ বিষয়গুলো বাস্তবে তো আবেগের বস্তু নয়। এগুলো মূলত মৌলিক অধিকারের শ্রেণিভুক্ত বিষয়। কোনও জনগোষ্ঠী যদি মনে করে এই সব মৌলিক অধিকারগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে, তাকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করাটা একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব। দায়িত্ব দেশের সংবিধানের। যে রাষ্ট্রের তারা অধীন, সেই রাষ্ট্রের। কোনও প্রাদেশিক সরকারের অংশ হলে, সেই সরকারেরও।

এখন প্রশ্ন হল, সেই দায়িত্ব কি পালিত হয়েছে? হয়নি। দায়িত্ব পালন কেন, পাহাড় পরিস্থিতির একটা সামগ্রিক পর্যালোচনা পর্যন্ত কখনও কেউ করেননি। এ বিষয়ে একটা কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তাও কেউ উপলব্ধি করেননি।

হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। সামগ্রিক ছবিটা তো কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। দেখছেন খণ্ডাংশে। শতাংশের হিসাবে ছয়, চৌত্রিশ বা চল্লিশ। যাঁরা সামগ্রিকতায় দেখতে পারতেন, তাঁরা সকলে আবেগে আচ্ছন্ন।

মজাটা হল, ভোটটাও হয় আবেগে। ভোটের ভাবনাই যাঁদের কাছে বড় ভাবনা, তাঁরা কোনও কিছুকেই ভোটের ওপরে স্থান দেবেন না। সেটা দোষও নয়। হয়তো ব্যবস্থারই সীমাবদ্ধতা। কারণ, ভোটে জিতেই তো ক্ষমতায় আসতে হয়। আর সেই ক্ষমতাও মাত্র পাঁচ বছর মেয়াদের। ক্ষমতায় যাঁরা আছেন, মেয়াদ শেষে তাঁরা আবার ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। যা যা করলে তাঁদের সুবিধা হবে তা-ই করবেন। যা যা না করলে তাঁদের সুবিধা হবে সেগুলো করা থেকে বিরত থাকবেন। আবেগে যদি ভোট হয়, তবে সেই আবেগকে জল-হাওয়া দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হবে। যতই অন্য এক দল মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াক সেই আবেগ। ক্ষমতার অসমীকরণে তাদের অংক তিন বনাম দুশো বিরানব্বই।

আবেগে যে ভোট হয় সে কথা সমতলের মতো পাহাড়েও সত্যি। হিল কাউন্সিলের হাত ধরে ভোটাভুটির রাজনীতি শুরু হতেই সেটা বুঝে গেছে পাহাড়ের দলগুলোও। ফলে অধিকারকে আবেগ বলে দেখানোর উলটো ছবিতে রং পড়েছে দুদিক থেকেই। মাঝে পড়া পাহাড়ের মানুষকে এটাও বুঝতে হবে স্পষ্ট করে।

মাসাধিক কাল পেরিয়ে গেল পাহাড়ের অচলাবস্থা। সব কিছু বন্ধ করে মানুষ আর কত দিনই বা থাকতে পারে! এ যেন নিজেই নিজের পরীক্ষা নেওয়া। সংসারে যেমন কেউ রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয়— সে তো প্রিয়জনকে চাপে ফেলার জন্যই। সে না খেলে পরিবারের অন্যরাও খেতে পারবে না। পারলেও দুঃখে থাকবে। কিন্তু যদি তাতে পরিবারের কিছুই এসে না যায়, তা হলে বুঝতে হবে ওটা তার পরিবারই নয়। দার্জিলিঙের সাধারণ মানুষ কি এখন সেই রকম কিছু ভাবছে? ভাবতে বাধ্য হচ্ছে? যদি তা-ই হয়ে থাকে, বুঝতে হবে বিষয়টা আরও জটিলতার দিকে চলে যাচ্ছে। কারণ এ ক্ষেত্রে পরীক্ষাটা পরিবারেরও। ঠিক কতটা অবিচ্ছেদ্য সে মনে করে তারই তথাকথিত দেহাংশকে, তার পরীক্ষা। সেই অঙ্গটুকুর হানি হলে সে কি সত্যিই প্রতিবন্ধী হয়ে পড়বে। নাকি আবেগে একটু চোট খেলেও রোগমুক্তির স্বস্তিতে আয়েশ করে ঘুরে বসা যাবে তিলোত্তমার দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি রেখে।

এই বন্‌ধ তো এক দিন না এক দিন শেষ হয়ে যাবেই। এই তীব্রতাও থাকবে না আন্দোলনের। হিল কাউন্সিল বা জিটিএ গোত্রীয় কোনও এক হাল-সামাল ধরনের সমাধানসূত্রও হয়তো বেরিয়ে আসবে। একশো দশ বছরের ইতিহাসের গতি আবার নেমে যাবে খাদে। বিস্রস্ত সম্পর্কগুলো আবার পুনর্বিন্যস্ত হবে সমবেত সুখের সমঝোতায়। মানুষ ফিরে যাবে যে যার অভ্যস্ত রোজনামচায়। শুধু একটা অংশ রয়ে যাবে যারা কোনও দিন আর সংবিৎ ফিরে পাবে না। কারণ তারা ফিরে পাবে না তাদের হারানো প্রিয়জনদের। এতখানি হারিয়েও যে বদলে কিছু পাওয়া হল না, এই ক্ষোভ তাদের বাড়তেই থাকবে। ঠিক কার বিরুদ্ধে সে কথা একমাত্র ইতিহাসই বলতে পারবে, আবার যখন সে উঠে আসবে খাদ থেকে।

Political parties Gorkhaland Darjeeling Bimal Gurung GTA
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy