অলীক কুনাট্য রঙ্গ কোথায় পৌঁছতে পারে, মধুসূদন দত্ত ভাবতেও পারতেন না। রাঢ়ে বঙ্গে তো সে রঙ্গের বেসাতিতে এখন সর্বদলীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমনকী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ব্র্যাকেটে মার্ক্সবাদী-র রাজ্য সম্পাদক মশাইও তাঁর পরিচিত বাক্সংযম জলাঞ্জলি দিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে ‘ওঁদেরই ভাষায়’ গালিগালাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন! কিন্তু তামাম ভারত জুড়ে যে প্রেতনৃত্যের প্রদর্শনী চলছে, বঙ্গভূমি তার কাছে কিছুই নয়। এই কুনাট্যপ্লাবনে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যে ভেসে গিয়েছে, যেটুকু বাকি আছে তারও অনেকটাই ডুবুডুবু। এক এক দিন এক এক বিষয়ে মহাবিতর্ক: দীপিকা পাড়ুকোনের নাকটাই শুধু কাটা দরকার, না কি গোটা মুন্ডুটাই চাই? জাতীয় সংগীতের সময় যে উঠে দাঁড়ায় না, সে কি দেশদ্রোহী? ক্যানসার কি পাপের ফল? প্রত্যেক হিন্দুর কি চারটি করে সন্তান হওয়া উচিত? (চারটিই ছেলে হওয়া আবশ্যক, না মেয়েও চলবে?)
এই বাজারে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের খবর নিয়ে যে বিশেষ তাপ-উত্তাপ দেখা যাবে না, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ২০০৫ সালে মনমোহন সিংহের সরকার গ্রামাঞ্চলে জনস্বাস্থ্যের প্রসারে এই মিশন শুরু করেছিল, ২০১৩ সালে তা শহরেও চালু হয়। বিশেষ গুরুত্ব পায় সেই সব রাজ্য, জনস্বাস্থ্য পরিষেবায় যারা পিছিয়ে। বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক সরবরাহ, সস্তায় বা বিনা খরচে জীবনদায়ী ওষুধের জোগান, পরিস্রুত পানীয় জলের বন্দোবস্ত— এমন বহু বিষয়কেই এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। স্বীকৃত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী (আশা) বা জননী সুরক্ষা যোজনার মতো নানা উদ্যোগ চলছে এই মিশনের অঙ্গ হিসেবে। ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ নামক লক্ষ্যটির পূরণে এই উদ্যোগের একটা বড় ভূমিকা আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটের প্রায় অর্ধেকটাই এখন এই মিশনের মাধ্যমে খরচ হয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য অনেকগুলো দফতরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই প্রকল্প চালায় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। বিভিন্ন রাজ্যে জনস্বাস্থ্য প্রসারের কাজকর্ম পর্যালোচনা করে এবং সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির মতামত জেনে এ বছর গোড়ার দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রক স্থির করেছিল, আগামী তিন বছরে এই মিশনের জন্য মোটামুটি এক লক্ষ সত্তর হাজার কোটি টাকার দরকার। কিন্তু অরুণ জেটলি শেষ পর্যন্ত যে বরাদ্দ মঞ্জুর করেছেন, সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রকের চাহিদার চেয়ে প্রায় কুড়ি শতাংশ কম। কেন এই ছাঁটাই? চেনা প্রশ্নের চেনা উত্তর: বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, তা ছাড়া অনেক রাজ্য বরাদ্দ টাকা খরচ করে উঠতে পারে না।
রাজ্য ‘খরচ করে না’ বলে বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের বস্তাপচা যুক্তি না দেখিয়ে জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে রাজ্যগুলিকে কেন টাকার সদ্ব্যবহারের জন্য চাপ দেওয়া যায় না, সে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই— ওটা যুক্তি নয়, অজুহাত। আর, খরচ কমালে তো ঘাটতি কমবেই, কিন্তু ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন খরচ কমানো দরকার সেটা কী ভাবে ঠিক হবে? অগ্রাধিকার বলে একটা ব্যাপার আছে। জনস্বাস্থ্য সেই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য নয়, এমন কথা কোনও দলের নেতা বা নেত্রীই মুখ ফুটে বলতে পারবেন না। অথচ বাজেট মেলানোর সময় হলেই দেখা যায়, স্বাস্থ্য বরাদ্দে কোপ পড়ছে। এ ব্যাপারে কোনও জমানার ইতিহাসই গৌরবের নয়। দীর্ঘকাল এ দেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় জাতীয় আয়ের এক শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। খুব কম দেশের অবস্থাই এতটা করুণ। চিনে অনুপাতটা এর প্রায় দ্বিগুণ, তাইল্যান্ডে আড়াই গুণ, শ্রীলঙ্কাতেও প্রায় দেড় গুণ। সেই কোন কাল থেকে বলে আসা হচ্ছে, স্বাস্থ্যের জন্য সরকারি ব্যয় জাতীয় আয়ের অন্তত তিন শতাংশ হওয়া উচিত। প্রথম ইউপিএ-র অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচিতেও দুই থেকে তিন শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার কথা ছিল। কথাই সার।
ক’মাস আগে ঘোষিত জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে মোদী সরকারও বলেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যয় হবে জিডিপির আড়াই শতাংশ। তা, ২০২৫ আসতে বছর সাত-আট বাকি, সুতরাং স্বাস্থ্য মিশনের বরাদ্দ ছাঁটা যেতেই পারে। জনস্বাস্থ্যের অত্যাবশ্যক কাজকর্ম টাকার অভাবে আটকে যাবে? ও রকম তো কতই যায়। যাঁদের স্বাস্থ্যনীতিতে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা’র কথা বলার পরেই সেই পরিচর্যার সুযোগ নানা ভাবে সীমিত করার কৌশল জারি থাকে, তাঁরা ও সব নিয়ে ভাববেন কেন?
অর্থনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী জঁ দ্রেজ তাঁর সেন্স অ্যান্ড সলিডারিটি নামক নতুন সংকলনের একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ভারতে সরকারি নীতির খামতিগুলি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রকট। ‘বিশেষত জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে ভারতের হাল ভয়াবহ।’ এর নানা কারণ। এ বিষয়ে অনেক গবেষণা ও সমীক্ষা হয়েছে। ২০১৫-র অক্টোবরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকাল রিসার্চসহ কয়েকটি সংস্থা যৌথ ভাবে বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাধির প্রকোপ নিয়ে বিশদ সমীক্ষা শুরু করে। সম্প্রতি তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে স্বাস্থ্য পরিষেবার নানা ত্রুটির কথা বলা হয়েছে। যেমন যথেষ্ট চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব। যেমন স্বাস্থ্য বিমার অসম্পূর্ণতা। যেমন কোথায় কখন কোন ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হচ্ছে, বিশেষত মৃত্যুর পিছনে কোন ব্যাধি কতটা দায়ী, সে বিষয়ে বিশদ তথ্যের অভাব। বস্তুত, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে প্রভূত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে রিপোর্টটিতে। পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গির তথ্য নিয়ে যা দেখা গেল, সেই কাহিনি মনে পড়বেই। কিন্তু সমীক্ষকরা এই গোড়ার কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় বাড়ানো দরকার। বরাদ্দ বাড়ানোর দায় অবশ্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যের ওপর— কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবস্থাপনায় চালিত সমীক্ষার রিপোর্টে সেটা প্রত্যাশিত— কিন্তু জনস্বাস্থ্যের জন্য যে যথেষ্ট টাকা চাই, সেই সত্য স্পষ্ট।
মুশকিল হল, কী কেন্দ্র, কী রাজ্য, কোনও সরকারই সত্য নিয়ে ভাবিত নয়। স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট টাকা দরকার, এই দাবিটা যদি একটা জোরদার সামাজিক এবং রাজনৈতিক দাবি হয়ে ওঠে, তা আদায়ের জন্য যদি সংগঠিত আন্দোলন চলে, তবেই ইতিহাস বদলাতে পারে। আপাতত তার আশা নেই। অন্যদের কথা ছেড়েই দিলাম, সূর্যকান্ত মিশ্ররা অন্তত এ দিকে একটু মন দিতে পারতেন। তাঁদের রাজ্যপাট গিয়েছে, আপাতত ফেরার ভরসা নেই, জাতীয় রাজনীতির আসরে তাঁদের নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, এমনকী সিবিআইয়েরও না, এই বেলায় কমরেডরা প্রাথমিক শিক্ষা বা জনস্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলি নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে পারতেন, নিজেদেরও একটু নড়াচড়া হত। ‘ওঁদের ভাষা’টা ওঁদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের ভাষা তৈরি করার একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু কার সাধ্য, তাঁদের মার্ক্সবাদকে ব্র্যাকেট থেকে বের করে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy