Advertisement
E-Paper

অন্ধকারের উৎস হতে

সদ্য প্রকাশিত হাই মাদ্রাসা (দশম) পরীক্ষার মেধা তালিকাতে অষ্টম হয়েছে প্রশমা শাসমল (ছবিতে)। রাজ্যে এই প্রথম কোনও অমুসলমান পড়ুয়া হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম দশে জায়গা করে নেওয়ার দরুন বেশ সাড়া পড়েছে।

তাজুদ্দিন আহ্‌মেদ

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ০৯:৩০

সদ্য প্রকাশিত হাই মাদ্রাসা (দশম) পরীক্ষার মেধা তালিকাতে অষ্টম হয়েছে প্রশমা শাসমল (ছবিতে)। রাজ্যে এই প্রথম কোনও অমুসলমান পড়ুয়া হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম দশে জায়গা করে নেওয়ার দরুন বেশ সাড়া পড়েছে। বর্তমান ভারতে রাজনীতির কারবারিরা যে ভাবে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়িয়ে চলেছেন, সেই প্রেক্ষিতে প্রশমার সাফল্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। আরও লক্ষণীয়, এ বছর তৃতীয়, যুগ্ম সপ্তম, যুগ্ম অষ্টম ও দশম স্থান অধিকার করেছে মেয়েরা। ২০১৬-য় মেয়েদের সাফল্য ছিল আরও নজরকাড়া। প্রথম দশের মধ্যে আটটি স্থান ছিল মেয়েদের।

মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে মুসলমান সমাজ অনাগ্রহী, এমন একটি ধারণা প্রশাসন, নীতিনির্ধারক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে বহু কাল ধরেই প্রচলিত। এর দু’টি ব্যাখ্যা আছে। প্রথমত, মুসলিম সমাজ চায় মেয়েদের কর্মের পরিধি থাকুক ঘরের মধ্যেই, বিদ্যালয়ের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নয়। দ্বিতীয়ত, বিয়ের পর মেয়ের ঠাঁই শ্বশুরবাড়ি, তাই মেয়েদের শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় ঠিক লগ্নি নয়, কারণ তার সুফল অন্য পরিবার ভোগ করে।

এই সব ধারণা আদতে ‘মিথ’মাত্র, অন্তত আজকের মুসলিম সমাজের চিন্তাভাবনার নিরিখে তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। এর ইঙ্গিত উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ের বেশ কয়েকটি সমীক্ষাতে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় যে জীবিকা এবং স্বাস্থ্যের মতো, শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে পড়েছে, সে কথা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবেই উচ্চারিত হয়েছিল সাচার কমিটির রিপোর্টে। পরবর্তী সময়ে, অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ এবং গাইড্যান্স গিল্ড-এর সমীক্ষাতেও দেখা গেছে যে অন্তত ১৭ শতাংশ মুসলিম পরিবারে কোনও সাক্ষর সদস্য নেই এবং অন্তত ৫১ শতাংশ পরিবারে সর্বোচ্চ শিক্ষার মান প্রাথমিক। কিন্তু এমতাবস্থাতেও অন্তত দুটি বিষয়ে আলোর সম্ভাবনা লক্ষ করা গেছে এই সমীক্ষাতে।

প্রথমত, অধিকাংশ মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাতে নারী-পুরুষ অনুপাত রাজ্যের গড়ের চেয়ে ভাল। আরও উল্লেখযোগ্য হল, যে শিশুদের মধ্যে এই অনুপাত অনেকগুলি মুসলমান-প্রধান এলাকাতে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, রাজ্যব্যাপী গড়ের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম এলাকাতে স্কুলে ভর্তি হওয়ার হার রাজ্যের গড়ের চেয়ে বেশি। এবং মুসলমান মেয়েদের মধ্যে এই হার, বিশেষত মাধ্যমিক বা সমতুল মানে ভর্তি হওয়ার নিরিখে, যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। এই দুই পর্যবেক্ষণকে জুড়ে দিলে এটা কি বলা যেতে পারে যে, মুসলমান সমাজে এখন কন্যাসন্তান যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য এবং সেই সন্তানের শিক্ষার জন্য পরিবার সাধ্যমত চেষ্টা করে? এরই কি প্রকাশ ঘটেছে হাইমাদ্রাসা ও অন্যান্য রাজ্য স্তরের পরীক্ষাতে?

রাজ্যের মাদ্রাসা বোর্ড প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে (অগস্ট ২০১০) রাজ্যে স্বীকৃত মাদ্রাসাগুলিতে পড়াশোনা করে প্রায় ৪ লক্ষ ৪৭ হাজার পড়ুয়া, যার ৫৯.১১ শতাংশ অর্থাৎ ২,৬০,২৩৩ জন হল ছাত্রী। রাজ্যের খারিজি মাদ্রাসাগুলি নিয়ে সে রকম কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও শতাংশের হিসাবে সেখানেও ছাত্রীর সংখ্যা বেশি বলেই অনুমান করা যায়। মাদ্রাসাগুলির শিক্ষার মান নিয়ে সংশয় থাকলেও এই শিক্ষাব্যবস্থায় মেয়েদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চয়ই সদর্থক বার্তা বহন করে। শিক্ষার মানের কথা উঠলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ এখন আল আমিন মিশন-এর কথা বলেন। ২০১৬ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে প্রায় ৫০০ মেধাবী ছাত্রী। রাজ্য সরকার পরিচালিত মেডিক্যাল এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে যথাক্রমে ২৯ এবং ৩১ জন সাফল্য লাভ করলেও ২০১৬ সালে ৮৪ জন ছাত্রী উত্তীর্ণ হয়েছে। রাজ্যের এক মাত্র সংখ্যালঘু স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় হল কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে অনেকটা। ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে এই প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের মধ্যে ছাত্রী ছিল যথাক্রমে ১৯, ২৫ এবং ২৭ শতাংশ। ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ছিল মাত্র ১১.৫ শতাংশ।

শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের এই ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ কিন্তু বহু বাধা অতিক্রম করেই সম্পন্ন হচ্ছে। প্রধান অন্তরায় দারিদ্র। আল আমিন মিশনের সফল ছাত্রীর দল কিংবা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নিয়ে পাঠরত মেয়েদের বেশির ভাগই এসেছে এমন সব হতদরিদ্র পরিবার থেকে যেখানে সে হল প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। কন্যাশ্রী বা সংখ্যালঘু দফতর থেকে দেওয়া প্রি-ম্যাট্রিক এবং পোস্ট-ম্যাট্রিক-এর মতো কিছু স্কলারশিপ সাহায্য করলেও তাদের লড়াই কঠিন। এই লড়াইয়ে তাদের প্রধান অবলম্বন হল নিজেদের হার-না-মানা জেদ আর পরিবারের তীব্র আকুতি। এই আকুতি বাবার মধ্যে থাকে, কিন্তু হয়তো বা অনেক বেশি করে থাকে মায়ের মধ্যে। বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠনের হয়ে যাঁরা মুসলমান সমাজের অন্দরে ঢুকে কাজ করেছেন তাঁদের সবার কথায় বার বার উঠে আসে এই সব দরিদ্র মায়েদের কথা। এঁরা নিজেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরক্ষর। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান যে, নিজের মেয়েদের অসহায়তা ও পরনির্ভরতার দুষ্টচক্রের মধ্যে ফেলে রাখতে নারাজ। তাই সর্বস্ব পণ করেও তাঁরা মেয়েকে রেখে আসেন আবাসিক বিদ্যালয়ে কিংবা দূর কলকাতার মেসে; অন্ততপক্ষে ঠেলে পাঠান গাঁয়ের ইস্কুলে। মেয়েদের চোখ দিয়েই তাঁরা দেখেন বন্ধন মুক্তির স্বপ্ন।

তিন তালাক নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্ক। মুসলমান মহিলাদের ভাগ্য নির্ধারণে বসেছে পণ্ডিতের দল। বেশির ভাগ পুরুষ। আমরা অপেক্ষা করছি কবে তৈরি হয়ে আসবে আমাদের কন্যার দল, আজ যারা ইস্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাদের হাত ধরে নিশ্চয়ই আসবে মুক্তি।

Prashama Shasmal Women School education
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy