Advertisement
E-Paper

ভারত দিয়ে চিন সামলানো?

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০০৭-এর অগস্ট মাসে ভারতীয় সংসদে বক্তৃতার সময়ে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ শব্দটি উল্লেখ করেছিলেন।

সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৭ ০১:০৩
দাঁড়িপাল্লা: যথাক্রমে নরেন্দ্র মোদী ও শি চিনফিংয়ের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

দাঁড়িপাল্লা: যথাক্রমে নরেন্দ্র মোদী ও শি চিনফিংয়ের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় (এশিয়া-প্যাসিফিক) নামটি বিগত তিন দশকে বহু আলোচিত। ১৯৮৯ সাল থেকে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী (এপেক) গড়ে তুলতে প্রধানত প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী বেশ কিছু দেশ উদ্যোগী হয়। এই কারণে এপেক আজ একুশটি দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ জোটও বটে। কিন্তু ভারতসহ বহু দেশই চমকে ওঠে, যখন সম্প্রতি দীর্ঘ এশিয়া সফরে এসে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিয়েতনামের দা নাং শহরে দাঁড়িয়ে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় (ইন্দো-প্যাসিফিক) এলাকায় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। এর আগে মার্কিন বিদেশমন্ত্রী রেক্স টিলারসনও ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে একটি ‘অভিন্ন কৌশলগত কর্মক্ষেত্র’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ঠিক দুশো বছর আগে আমেরিকা প্রথম বার প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে তার যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। বহুপরিচিত সেই ‘প্রশান্ত মহাসাগর’ বা ইদানীং বহুচর্চিত ‘এশিয়া-প্যাসিফিক’ ছেড়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’-প্রীতি তাই প্রাথমিক ভাবে বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটায়।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০০৭-এর অগস্ট মাসে ভারতীয় সংসদে বক্তৃতার সময়ে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ শব্দটি উল্লেখ করেছিলেন। এর আগে ওই বছরই জানুয়ারি মাসে ভারত-জাপান সম্পর্কের বিন্যাস প্রসঙ্গে এক প্রবন্ধে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ক্যাপ্টেন গুরপ্রীত খুরানা ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ কথাটি আলোচনা করেন। ভারতীয় সংসদে সেই বক্তৃতার সময়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বলেছিলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ আসলে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর— এই দুইয়ের সংগমস্থল। এই সংগমের প্রসঙ্গটি তিনি যে ১৬৫৫-তে মুঘল যুবরাজ দারা শিকো প্রণীত একটি গ্রন্থের শিরোনাম থেকে গ্রহণ করেছেন, তা জানাতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী দ্বিধা করেননি। তিনি আশা করেন যে, এই এলাকাকে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকারের জন্য আরও উপযুক্ত করে তুলতে ভারত ও জাপানই ভরকেন্দ্র হয়ে উঠবে। অস্ট্রেলেশিয়া ও আমেরিকাকে নিয়ে সমন্বিত এই ‘বৃহত্তর এশিয়া’ মানুষ, পণ্য, পুঁজি ও জ্ঞানের অবাধ যাতায়াতের পথ সুগমই করবে। এই অঞ্চলে স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণে ভারত ও জাপানকেই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে বলে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছিল।

সেই পুরনো কথারই অনেকটা পুনরাবৃত্তি করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সম্ভবত তিনটি উদ্দেশ্য পূরণে আগ্রহী। এক, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ শব্দবন্ধের সঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মুক্ত চিন্তা যে ওতপ্রোত জড়িত, তা উল্লেখের প্রধান নিশানায় কিন্তু একদলীয় শাসনাধীন চিন। দুই, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবর) নীতি বা ‘সামুদ্রিক রেশম পথ’ (ম্যারিটাইম সিল্ক রোড) নীতির মাধ্যমে বেজিং, এশিয়া মহাদেশ ছাড়িয়ে ইউরোপ ও আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত যে চিনা বলয়ের বিস্তার ঘটাতে আগ্রহী, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ তারই প্রতিস্পর্ধী এক ভাবনা। তিন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ কথাটিতে ভারতের পৃথক ও স্পষ্ট উল্লেখের মধ্য দিয়ে এই রণকৌশলে দিল্লিকে আমেরিকা পুরোভাগে রাখতে চায়।

প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার তিনশো দিনের মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে গেছেন। পাঁচ বছরের পুরনো দক্ষিণ কোরিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (কোরাস) অবাধ বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেছেন। বহুপাক্ষিক ইরান পরমাণু চুক্তিকে অকেজো করেছেন। এমনকী তিন দশকের পুরনো উত্তর আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (নাফটা) থেকে সরে আসার হুমকি দিয়েছেন। ওয়াশিংটন নিজেই অন্যতম রূপকার হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা প্রয়োজনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউ টি ও)-র নীতি বর্জনে যে পিছপা হবে না, এমন ইঙ্গিত মিলেছে। এই সবেরই কারণ, ট্রাম্পের ‘আমেরিকাই প্রধান’ নীতি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি যে বহুপাক্ষিক বোঝাপড়ার চাইতে দ্বিপাক্ষিকতার পথে চলতে স্বচ্ছন্দ, এ কথাও যথেষ্ট স্পষ্ট।

ট্রাম্পের এই নীতি তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামার বিশ্বদর্শন থেকে কতটুকু আলাদা, সময়ই তা বলবে। তবে, ওবামা এশিয়াকে সমকালীন দুনিয়ার নতুন ভরকেন্দ্র হিসেবে দেখবার পক্ষপাতী ছিলেন। আর ট্রাম্পের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ নীতি মূলত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পথে আঞ্চলিক বিকাশের স্বপ্ন দেখায়। ওবামা পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতে আমেরিকার ব্যয়বহুল সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচিকে ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রিত করে এশিয়াতে আমেরিকার জন্য নতুন সুযোগ সন্ধানে উৎসাহী ছিলেন। অন্য দিকে, ট্রাম্প সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার উচ্চাভিলাষী ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে বাগে এনে উদীয়মান এশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আমেরিকাকে প্রস্তুত করতে উদ্যত। এই মহাদেশে আর্থিক দিক থেকে বর্তমানে সব চাইতে শক্তিশালী চিনের মোকাবিলায় তাই ওয়াশিংটন এই মাপকাঠিতে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা জাপান ও ভারতকে নিজস্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামিল করতে চাইছে। ট্রাম্পের আমেরিকা নিজে প্রচলিত বহু নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করতে রাজি নয়, তার মুখে ‘নীতি-নির্ভর ইন্দো-প্যাসিফিক’-এর বুলি একটু বেমানান বইকি!

একুশ শতককে নিজস্ব শতকে রূপান্তরিত করতে চাইলে পূর্ব ও দক্ষিণ চিন সাগরে যে চিনা অনুশাসন গড়ে তোলা দরকার, বেজিং তা বিলক্ষণ জানে। নিজের লক্ষ্য পূরণে চিন এর মধ্যেই মায়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও মলদ্বীপের সমুদ্র উপকূলে নিজের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। নয়াদিল্লির কাছে তা রীতিমত উদ্বেগজনক। অপর পক্ষে, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’-এর ধারণায় ভারতই কেন্দ্রবিন্দুতে, চিন নয়। নিজেকে জং গুয়ো বা পৃথিবীর ‘মধ্যম রাজ্য’ ভাবতে উৎসাহী বেজিংয়ের চোখে তাই ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ বেশ সন্দেহজনক। বস্তুত, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির উনিশতম কংগ্রেসে চিনকে বিশ্বের দরবারে জাহির করবার নীতি মান্যতা পেয়েছে। রাষ্ট্র-নির্দেশিত বাজার অর্থনীতি, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং চিনা সার্বভৌমত্বের অভিপ্রায়— এ বারের দলীয় সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংয়ের নবজীবনপ্রাপ্ত কর্তৃত্ব এই সব ধারণাকেই তুলে ধরেছে। কার্যত, এই কংগ্রেসে ২০৫০ পর্যন্ত চিনের পথদিশা চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে ওয়াশিংটন যদি অভীষ্ট এই নতুন মিতালিকে নিতান্তই চিনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাময়িক প্রভাব মোকাবিলার উদ্দেশ্যে কাজে লাগায়, তা হলে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ নীতি সমগ্র অঞ্চলে আরও সংঘাত ও অস্থিরতার জন্ম দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া— এই চারটি দেশকে নিয়ে পরিকল্পিত চতুষ্ক (কোয়াড্রাঙ্গল)-এর নেতৃত্বে যে ভাবে এই এলাকায় স্বাধীনতা, অকপটতা, সততা আর স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নীতি প্রস্তাবিত, বেজিং তা সহজ ভাবে না নিলে আশ্চর্যের কিছু নেই। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’-এর ধারণা শুধুমাত্র ‘দ্বিসামুদ্রিক ভূগোল’, না কি অন্যতর বৃহত্তম কোনও কর্মপরিকল্পনা, সময়ই তা জানাবে। শেক্সপিয়র বলেছিলেন, নামে কী-ই বা এসে যায়? ঠিক। তবে যে নামে ডাকি— ‘এশিয়া-প্যাসিফিক’ বা ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’— আখেরে তার সারবস্তু কী, তা আগে জানা দরকার। ট্রাম্পের নতুন ঘোষণার কেন্দ্রবিন্দুতে ভারত, শুধুমাত্র এই বিশ্বাস নয়াদিল্লিকে আপাতত উল্লসিত করতে পারে। কিন্তু ভারত যেহেতু এই অঞ্চলে অবস্থিত এবং ভৌগোলিক ভাবে চিনের নিকটতম প্রতিবেশী, তাই সময় থাকতে পারের কড়ির বিশদ হিসেবনিকেশ না করলে ভারতের হয়তো অনেক কিছু যাবে, বিনিময়ে আসবে না তেমন কিছু। নিজের সাধ আর সাধ্যের ব্যবধান উপলব্ধি করেই বোধহয় নবতম স্বীকৃতির পালক মুকুটে পরিধান নয়াদিল্লির পক্ষে শ্রেয়।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

Donald Trump India US China Xi Jinping Narendra Modi Indo-Pacific policy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy