যুগল: ‘কূটনীতিতে একটি কথা আমলাদের লব্জ: ইট টেকস টু টু ট্যাঙ্গো’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চিনা
ডমরুচরিতের সেই গপ্পোটিকে যদি সামান্য বদলে নেওয়া যায়! বৃদ্ধ ড্রাগন (মূল গল্পে বাঘ) আকাশ পাতাল জুড়ে হাঁ করে আছে। সেই হাঁ-মুখে মৃগ, মহিষ, বন্য বরাহ প্রবেশ করছে একে একে। একমাত্র বুক ঠুকে তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আমাদের ডমরুধর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই আগুনে দৃষ্টি সামলাতে না পেরে লেজেগোবরে হয়ে ড্রাগনের পেটে! উদ্ধারের আশায় কী ভাবে কাঁচা সোডা গায়ে মাখতে হল (ড্রাগনের পেটের অম্লরস প্রশমিত করার জন্য), কখনও পির সাহেব কখনও মা ভগবতীকে ডাকাডাকি চলল, বমির ওষুধ জোগাড় করা হল (যাতে বমির সঙ্গে বেরিয়ে ডমরু স্বস্তি পেতে পারে) তা ত্রৈলোক্যনাথের রসিক পাঠকমাত্রই জানবেন!
ডমরুধরের ছাতির মাপ কত ছিল, কেনই বা সে ওই অবিমৃশ্যকারিতা দেখাতে গিয়েছিল সে আখ্যান স্বতন্ত্র। কিন্তু এই অগ্নিগর্ভ প্রতিবেশী বলয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সাউথ ব্লকের হতভম্ব কূটনীতি, ওই গপ্পোটিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি চিনের বিদেশ মন্ত্রক বেজিং থেকে জানিয়েছে, এশিয়ায় নাকি বিস্তর পরিসর আছে। ভারতের হাতি এবং চিনের ড্রাগন হাতে হাত মিলিয়ে নাচতেই পারে।
শুনতে ভাল। পরিসর আছে, সেটাও ভুল নয়। কিন্তু বাস্তব ছবিটা ঠিক কী? কূটনীতিতে একটি কথা, দেশনিরপেক্ষ ভাবেই, আমলাদের লব্জ: ইট টেকস টু টু ট্যাঙ্গো।
নাচছে বটে ভারত, কিন্তু তা কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিপাকে পড়ে যাওয়া একার নৃত্য! কূটনৈতিক প্রথাকে উল্টে দিয়ে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে দু’-দু’বার চিন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এপ্রিলের শেষে এবং জুনের গোড়ায়। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী— চিন যাওয়ার ধুম লেগে গিয়েছে গত দেড় মাসে! দলাই লামাকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, হিন্দি-চিনি ভাই ভাই! কেননা হাত বাড়ালে সত্যিই যে কোনও বন্ধু নেই পাড়াপড়শিতে। ভুটানকে বুঝিয়ে, পাশে না নিয়েই ডোকলামে আড়াই মাস ধরে বুক বাজিয়ে তাল ঠুকেছে নয়াদিল্লি। কার সঙ্গে? না, সামরিক শক্তি থেকে অর্থনীতি— সব কিছুতে না-হোক পাঁচগুণ বড় একটি দেশের সঙ্গে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু ভবনে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র তখন প্রতি সপ্তাহে সাংবাদিক সম্মেলনে স্বর চড়াতেন। যেন ‘আজ বাদে কাল যুদ্ধু হবে!’
এটা ঠিকই যে উরি হামলার পর সার্ক দেশগুলিকে একজোট করে পাকিস্তান-বিরোধিতার প্রশ্নে একটি সাময়িক মঞ্চ তৈরি করতে পেরেছিল ভারত। সে সময় ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলন বাতিল করার ব্যাপারে সহমত হয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রনেতারা। কিন্তু বাসর ঘরে অন্য ছিদ্র দিয়ে যে ড্রাগন ঢুকছে, তা পাকিস্তান-কাঁটায় রক্তাক্ত সাউথ ব্লক হয় খেয়াল করেনি, অথবা খেয়াল করলেও তাকে কঠোর হাতে মোকাবিলা করার মতো প্রখর কূটনৈতিক মেধা বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার কারও ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ, ভুটান, মায়ানমার—প্রত্যেকটি দেশে পিএলএ (পিপলস লিবারেশন আর্মি)-র বুটের দাগ অথবা চিনা ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ঝঙ্কার ক্রমশ গভীর হয়েছে। পরিকাঠামো বানিয়ে দেওয়ার ছলে বেজিং অনায়াসে কোনও রাষ্ট্রে দখল নিচ্ছে বন্দরের, কোথাও সাজাচ্ছে কৌশলগত ঘাঁটি, কোথাও বা চড়া সুদে ঋণ দিয়ে কার্যত কিনে নিচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাড়ানো হচ্ছে চিনা আধিপত্য। পর্যবেক্ষকদের মতে, এর একটা উদ্দেশ্য যদি হয় এশিয়ার ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে ট্যাঁকে পোরা, অন্যটি হল ভারতকে ক্রমশ এই লড়াইটা থেকে ছিটকে হীনবল করে দেওয়া। অনেকে বলছেন, চিনের এই দুই উদ্দেশ্য আসলে একে অন্যের পরিপূরক। ভারতকে খেলা থেকে ছিটকে দিতে পারলে সামনের পথ হবে নিরঙ্কুশ।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নয়া ঔপনিবেশিকতার এই চাইনিজ চেকারের ঐতিহ্য কিন্তু রয়ে গিয়েছে তাদেরই বহু প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে। সেই হান সাম্রাজ্যে আশপাশের ‘বর্বর’ জনজাতি এবং ভূখণ্ডকে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রভুত্ব করার কৌশলটি তৈরি হয়েছিল জিশুর জন্মের শ’দেড়েক বছর আগে থেকেই। এডওয়ার্ড লাটওয়াক তাঁর দ্য রাইজ অব চায়না ভার্সেস দ্য লজিক অব স্ট্র্যাটেজি গ্রন্থে বলছেন, এই নোমাড যোদ্ধাদের প্রথমে বিনা মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে তাদের নির্ভরশীলতা কেনা হত। তার পর ধীরে ধীরে এই পণ্যের বদলে চাওয়া হত পরিষেবা। কালক্রমে বানানো হত ক্রীতদাস।
আজকের চিনা মহাযোগাযোগ প্রকল্প ওবর-কে সেই হান সাম্রাজ্যের ঋণের ফাঁদের নবীন সংস্করণ হিসাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট’-এর সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ওবর প্রকল্পে চিনের সঙ্গে যুক্ত এমন ৬৮টি দেশের মধ্যে অন্তত ২৩টি দেশের চিনা ঋণের ফাঁদে বিকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। চাইনিজ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে পরিকাঠামোর জন্য ঋণ দেওয়া হবে দেশগুলিকে। সেখানে কাজ করবে চিনা সংস্থা এবং চিনা কর্মীরা। পরিকাঠামোর যাবতীয় সুবিধা বেজিং নেবে, সেটা ঋণের শর্তেই থাকছে। অন্য দিকে আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির হাতে রইল পেনসিল। সুদ গুনতে গুনতে তারা ক্রমশ প্রবেশ করবে ড্রাগনের পেটে।
ভারত খোলাখুলি এর প্রতিবাদ করেছে, ওবর প্রকল্পে যোগ না দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চের কাছে আবেদন করেছে, সবই ঠিক। কিন্তু দু’টি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এক, চিনের মহাযোগাযোগ প্রকল্পের পাল্টা কোনও কৌশল গত এক-দেড় বছরে সাউথ ব্লক বাস্তবায়িত করতে পারল কোথায়? দুই, নীতিগত বিরোধিতার প্রশ্নেই বা অটল থাকতে পারছে কোথায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার? ওবর-এর পাল্টা বলুন অথবা দক্ষিণ চিনা সাগরে বেজিংয়ের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে কৌশলগত জবাব দেওয়া— দু’টি ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে। বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনা নীতিতে তিতিবিরক্ত ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলি তো প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছে অন্য কথা। আসিয়ান ব্লকের অভিযোগ, ভারতকেই তো নেতৃত্ব অর্পণ করা হয়েছিল সমুদ্র-রাজনীতিতে একজোট হয়ে ড্রাগনের বিরোধিতা করার। কিন্তু বাৎসরিক মালাবার নৌ-মহড়া (আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে) এবং চতুর্দেশীয় অক্ষ গড়ে শম্বুক গতিতে এগোনো ছাড়া বলার মতো কোনও রান ভারতের ব্যাটে নেই।
দ্বিতীয় বিষয়টি আরও হতাশাজনক। নরম-গরম কূটনীতি বিশ্বব্যবস্থায় নতুন কোনও কৌশল নয়। কিন্তু কোন অনুপানে কতটা নরমের সঙ্গে কতটা গরম মেশালে প্রার্থিত চাপ তৈরি করা যাবে, তার নিক্তি মোদীর সরকারের হাতে দেখা যাচ্ছে না। বরং এই প্রশ্নে দৃশ্যতই দিশেহারা নয়াদিল্লি। কখনও নোট দিয়ে আমলা-মন্ত্রীদের সতর্ক করা হচ্ছে তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামার অনুষ্ঠানের ধারে কাছে না যেতে। কারণ, চিনকে চটানো চলবে না। তার পক্ষকালের মধ্যেই সেই দলাই লামার অনুষ্ঠানেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের। মলদ্বীপে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর গর্জন করেছিল ভারত। বলা হয়েছিল: চিন, তুমি হাত ওঠাও। ভ্রুক্ষেপ করেনি বেজিং। সেই নরেন্দ্র মোদী সরকারই এখন গোপনে চিনকে বার্তা দিয়েছে: আমরা মলদ্বীপ-সঙ্কট নিয়ে নাক গলা চ্ছি না, ভাই তোমরাও আর ঝামেলা বাড়িয়ো না! ওবর নিয়ে জবরদস্ত বিরোধিতার পর এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পাক-চিন আর্থিক করিডর নিয়ে বললেও ওবর নিয়ে কোনও সমালোচনা করা হবে না।
চিনের সঙ্গে সম্পর্কের তার যে নতুন করে বাঁধতে চাওয়া হচ্ছে, সে কথা ইতিমধ্যেই ঢাক পিটিয়ে বলতে শুরু করেছে বিদেশ মন্ত্রক। তারই প্রমাণ মোদীর আসন্ন জোড়া চিন সফর। কিন্তু তার বাঁধার কৌশলটি ভাল করে আয়ত্তে না আনতে পারলে, শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাজনা যে বেসুরো হবে, তা বোধ হয় গত এক বছরে যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy