Advertisement
E-Paper

উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে তাজা হাওয়া এনেছেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধী

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যদিও যুদ্ধ আর পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনও কথা শোনা যাচ্ছে না, যদিও এখনও মনে হচ্ছে, এই এক বিষয়ের উপর নির্ভর করেই আগামী নির্বাচনে উতরে যাওয়ার চেষ্টা করবে বিজেপি, আসলে কিন্তু ভারতের নির্বাচনী পটভূমিটা বেশ জটিল আর দ্বন্দ্বময়।

মৃণাল পান্ডে

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

আমার মা উত্তরপ্রদেশকে বলতেন ‘উল্টা প্রদেশ’। প্রতি পাঁচ বছরে এক বার দেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করে এই রাজ্য— সংখ্যার জোরেই। আর, বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, সেফোলজিস্টরা যা বলেছিলেন, উত্তরপ্রদেশের ভোট তার উল্টো পথে গিয়েছে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যদিও যুদ্ধ আর পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনও কথা শোনা যাচ্ছে না, যদিও এখনও মনে হচ্ছে, এই এক বিষয়ের উপর নির্ভর করেই আগামী নির্বাচনে উতরে যাওয়ার চেষ্টা করবে বিজেপি, আসলে কিন্তু ভারতের নির্বাচনী পটভূমিটা বেশ জটিল আর দ্বন্দ্বময়। কোন দ্বন্দ্বে যে কী ফল ফলতে পারে, তা এখনও মোটেই পরিষ্কার নয়। এই যেমন, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ মূলত তিনটি বড়, শক্তিশালী গোষ্ঠীর হাতে। প্রথমটি নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি— এই রাজ্যে দলের নিয়ন্ত্রক হলেন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ আর গোরক্ষনাথ পীঠ থেকে বেছে নেওয়া মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। দ্বিতীয় গোষ্ঠীকে স্থানীয় মানুষ বুয়া-ভাতিজার জোট হিসেবে চেনে। বিএসপি-র সভানেত্রী মায়াবতী আর সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদবের জোট। অখিলেশের বাবা, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবের সঙ্গে মায়াবতীর সম্পর্ক মোটেই মধুর ছিল না। উত্তরপ্রদেশের ইতিহাস জানে কেমন ছিল তাঁদের পারস্পরিক বৈরিতা। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এসে ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বিবদমান দুই দলই টের পেল, ২০১৯-এ হয় একসঙ্গে লড়তে হবে, নয় একা একা মরতে হবে। এই তাগিদ থেকেই তৈরি হল এক অসম্ভব জোট।

তৃতীয় শক্তির নাম কংগ্রেস। এক কালে উত্তর ভারতে অ-বিজেপি শক্তিগুলির মধ্যে প্রধান কংগ্রেস ২০১৪ সালের লোকসভায়, ২০১৭-র বিধানসভায় ধরাশায়ী হয়েছিল। দলের সভাপতি রাহুল গাঁধী সে রাজ্যে দায়িত্বে এনেছেন বোন প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরাকে। সঙ্গে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। উদ্দেশ্য, ভারতের বৃহত্তম রাজ্যটিতে দলকে চাঙ্গা করা। প্রাথমিক লক্ষণ বলছে, তাঁরা আংশিক ভাবে হলেও সফল হচ্ছেন।

ইন্দিরা গাঁধীর নাতনি, ৪৭ বছর বয়সি প্রিয়ঙ্কা লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ভোটে লড়লে কোন আসন থেকে, তা-ও জানা যায়নি এখনও। কিন্তু, তিনি আসায় একদা ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হওয়া লখনউয়ের পার্টি অফিসে যে মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে, সেটা চোখে পড়ার মতো। তাঁর মিছিলও দর্শনীয় হয়েছিল।

এক দিকে রাহুল আর প্রিয়ঙ্কা গাঁধী, অন্য দিকে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, এই ত্রয়ীকে নিয়ে চায়ের দোকান থেকে পার্টির সদর দফতর, সর্বত্রই জল্পনা প্রচুর। কোথাকার জল গড়িয়ে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, বলা মুশকিল। উত্তরপ্রদেশের স্বভাবই হল চুপচাপ পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা। রাহুল গাঁধী একাধিক বার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি বিজেপি-বিরোধী মহাজোটের সঙ্গী হতে চান। কিন্তু মায়াবতী রা কাড়েননি। গত বিধানসভা নির্বাচনে অখিলেশ রাহুলের সঙ্গে ছিলেন। এ বারও মনে হচ্ছে, বুয়াজি অমত না করলে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক।

ওপর থেকে দেখে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির চলন বোঝা মুশকিল। প্রিয়ঙ্কার রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে রাজ্যে উৎসাহ প্রচুর। রাজ্য কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর দলের সভাপতি ও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার সঙ্গে প্রথম বার লখনউয়ের রাস্তায় নেমে তিনি যা যা করার, সবই করলেন— খোলা গাড়ি থেকে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়লেন, হাসলেন, দু’একটা বাচ্চাকে কোলে তুলে নিলেন, তাদের চকোলেট দিলেন। কিন্তু, কোনও বক্তৃতা করলেন না। সাংবাদিক সম্মেলনও নয়।

কথা বলার ভার রাহুলের ওপর ছেড়ে তিনি দ্রুত রওনা হলেন তাঁর স্বামীর পাশে থাকতে— যে দিন প্রিয়ঙ্কা প্রথম উত্তরপ্রদেশের রাস্তায় নামবেন বলে ঠিক করা ছিল, সিবিআই ঠিক সে দিনটাকেই রবার্ট বঢরাকে জেরা করার জন্য বেছে নিল। সেই দায়িত্ব সেরে প্রিয়ঙ্কা ফের উত্তরপ্রদেশে ফিরে এলেন। দলের বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসীতেও যাবেন বলেই ঠিক হয়েছে। স্পষ্টতই, তিনি গোড়ায় উত্তরপ্রদেশের মানুষের মন বুঝে নিতে চান। কিন্তু, সে বড় সহজ সাধনা নয়। উত্তরপ্রদেশের মন বোঝা দুষ্কর।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে লড়বেন কি না, প্রিয়ঙ্কা এখনও তা না জানালেও বিজেপির আনাচকানাচ থেকে তাঁর দিকে পরিচিত নারীবিদ্বেষী মন্তব্য ভেসে আসতে আরম্ভ করেছে। এক নেতা বললেন, প্রিয়ঙ্কা আসলে চিকনা চেহরা— সুন্দরী মহিলা— ঠিক যেমন তাঁর ঠাকুরমার এক কালে পরিচিতি ছিল গুঙ্গি গুড়িয়া হিসেবে। আর এক বিজেপি নেতা বললেন, ‘‘হুঁ হুঁ বাবা! যখন প্রচারে বেরোন না, প্রিয়ঙ্কা তখন জিনস পরেন।’’ আঁচ করা যায়, এই নেতাদের কাছে জিনস হল পাশ্চাত্য নষ্টামির প্রতীক, ভারতীয় নারীর পরিধেয় হিসেবে নিতান্তই অগ্রহণযোগ্য। প্রিয়ঙ্কার স্বামী, তাঁর হরেক ‘জমি দুর্নীতি’, প্রিয়ঙ্কার ইটালীয় মা, ভাই নিয়ে নিরন্তর কাটাছেঁড়া তো আছেই।

তার পরও উত্তরপ্রদেশের তরুণ প্রজন্ম, মহিলারা যে ভাবে প্রিয়ঙ্কাকে দেখছেন, তাঁর কথা শুনছেন, সেটা দেখার মতো— তাঁদের মধ্যে উৎসবের মেজাজ, চোখে যেন একটা ঘোর। প্রিয়ঙ্কার হাস্যমুখী উপস্থিতির মধ্যে একটা সহজ ভাব আছে। বিশেষত তাঁর উল্টো দিকে থাকা গেরুয়াধারী তিলক কাটা নীরস বিজেপি নেতাদের তুলনায়। সেই নেতারা কঠিন মুখে ‘নামদার’দের সম্বন্ধে কটূক্তি করেন, নেহরু-গাঁধী পরিবারের সম্বন্ধে মন্তব্য ছুড়ে দেন। এই নেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে মুখের হাসিখানা বজায় রাখতে পারা নেহাত কম কথা নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, রাহুল-প্রিয়ঙ্কা যত বারই উত্তরপ্রদেশের রাস্তায় হেঁটেছেন, মানুষ ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। দিল্লিতে হরেক সরকারি সংস্থা তাঁদের সব সম্পত্তির তালিকায় চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে, কোনও একটা ছিদ্র খুঁজতে মরিয়া— প্রিয়ঙ্কা বিলক্ষণ জানেন। তার পরও প্রিয়ঙ্কা জনসমক্ষে শিষ্টতার গণ্ডি অতিক্রম করেননি কখনও। যোগী আদিত্যনাথ বা নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তাঁর মস্ত তফাত, তিনি এখনও অন্য রাজনীতিকদের হরেক কাণ্ডকারখানা দেখে মুচকি হাসতে পারেন, আর জনতার মধ্যেও আলগোছে ছড়িয়ে দিতে পারেন সেই মজাটুকু।

২০১৯ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেসের তরি কূলে আনতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর আরও কয়েক মাস পরে পাওয়া যাবে। কিন্তু যেটুকু এখনই স্পষ্ট, তা হল, প্রিয়ঙ্কা একটা কথা সার বুঝেছেন। তিনি টের পেয়েছেন, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-এর লাগাতার হুঙ্কার থাকা সত্ত্বেও মোদীর জমানায় আর্থিক অসাম্য ক্রমেই বেলাগাম হয়েছে। নতুন অর্থনীতির দখল নিয়েছে নিরঙ্কুশ স্যাঙাততন্ত্র। গ্রামেই হোক বা শহরে, সাধারণ মানুষ এখন খানিক সাম্যের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। টাকা আর ক্ষমতা, সবেরই আর একটু সুষম বণ্টন চাইছেন তাঁরা। এই কথাটা বুঝেছেন বলেই তিনি জমকালো সংবর্ধনা, লম্বাচওড়া বক্তৃতা এড়িয়ে চলতে পারছেন। গাড়িতে ওঠার জন্য ট্রাক থেকে লাফিয়ে নামার সময় হাসতে পারছেন, তদন্তকারী সংস্থার হাতে হয়রান হওয়া স্বামীর পাশে দাঁড়াতে পারছেন প্রকাশ্যে।

উত্তরপ্রদেশের তরুণ প্রজন্মের মেয়েদের কাছে প্রিয়ঙ্কার উপস্থিতি ঠিক কী অর্থ বহন করছে? আমি বলব, তাঁরা প্রিয়ঙ্কাকে দেখে একটা কথা বুঝছেন—যতই অবিচারের সম্মুখীন হতে হোক, সমাজ যতই তিরস্কার বা নিন্দা করুক, যত রকম বিপদই আসুক, নিজের গণতান্ত্রিক ও মানবিক বোধগুলোকে বাঁচাতে হলে সব বাধাকে হাসিমুখে অতিক্রম করা ভিন্ন উপায় নেই। সংসদে মোদী সরকারকে সুতীব্র আক্রমণ করার পর নিজের আসন থেকে উঠে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আলিঙ্গন করে শাসকপক্ষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন রাহুল গাঁধী। প্রিয়ঙ্কার মধ্যেও সে রকম একটা ব্যাপার রয়েছে। বিষ না উগরে যে তিনি সামান্য হাসির কথা দিয়েই কোনও প্রসঙ্গকে এড়িয়ে যেতে পারেন, এই ব্যতিক্রমী নিষ্কলুষতায় প্রতিপক্ষের রাশভারী নেতারা এখনও অভ্যস্ত নন।

প্রিয়ঙ্কার বয়স তাঁর পাশে আছে। হাতে এখনও অনেক সময় তাঁর। ঠিক যেমন রাহুল, জ্যোতিরাদিত্য আর অখিলেশের সামনেও আছে লম্বা রাজনৈতিক জীবন। উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দাদের শতকরা পঁচাত্তর ভাগই আবার তরুণ। তাঁরা অনেক দিন ধরে ভাগ্য বা রাজনীতির হাতে মার খাচ্ছেন। এক বা একাধিক তরুণ নেতা এই রাজ্যের ভাগ্য নতুন করে লিখবেন, অন্তত সেই চেষ্টাটুকু করবেন— এই দাবি করার অধিকার রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের বিলক্ষণ আছে।

সুতরাং, পুলওয়ামা-বালাকোট কাণ্ডের পর একটা উত্তরকাণ্ডও থাকতে পারে। উত্তরপ্রদেশে একটা কথা খুব প্রচলিত— অভি তো লীলা বাকি হ্যায়! নাটক এখনও শেষ হয়নি।

ভূতপূর্ব চেয়ারপার্সন, প্রসার ভারতী

Ppolitics India Congress Rahul Gandhi Priyanka Gandhi Uttar Pradesh Lok Sabha Election 2019
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy