তিনটি বৎসরের মধ্যে দেশের পরিবেশ এতটাই পরিবর্তিত যে বুধবার দিনটি কেবল ব্যতিক্রমী নহে, বিস্ময়কর ঠেকিবার জোগাড়। দেশের এতগুলি শহরে এত মানুষ অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে বাহির হইয়া আসিলেন, একত্র হইলেন, স্লোগান তোলা বা প্ল্যাকার্ড ধরিবার সাহস দেখাইলেন, কম কথা নয়। নাগরিক সমাজের এত স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ শেষ বার দেখা গিয়াছে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের সময়। কিন্তু তখন চারি পাশের হাওয়া ছিল ভিন্ন গতির। প্রতিবাদ, হইল বা সে প্রতীকী প্রতিবাদ, ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হইবার পর যতগুলি অসহিষ্ণুতার হত্যাকাণ্ড ঘটিয়া গিয়াছে, তাহার প্রেক্ষিতে জাতীয় স্তরে এই প্রথম গণ-প্রতিবাদই বলিয়া দেয় যে সেই পুরাতন হাওয়া আর নাই। এখন চার দিকে চাপিয়া বসিয়াছে ভয় অথবা অবিশ্বাসের বাস্তব। তাহারই মধ্যে ‘নট ইন মাই নেম’ প্রতিবাদ-শৃঙ্খল উত্তরে দিল্লি হইতে দক্ষিণে তিরুঅনন্তপুরম ও কোচি, পূর্বে কলিকাতা হইতে পশ্চিমে জয়পুর ও চণ্ডীগড়ে ছড়াইয়া ঈষৎ-বিস্মিত আশার সঞ্চার করিয়া গেল। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একাংশ যে নৃশংসতায় মাতিয়া উঠিয়াছে, সংখ্যাগুরুদের অপরাংশ তাহাকে সরবে সজোরে ধিক্কার জানাইল, নিজেদের আলাদা করিয়া লইবার শপথ লইল। কলিকাতার জমায়েতটির মাঝপথে অঝোর বর্ষা নামিলেও তাহা ভাঙিয়া গেল না, বরং আগন্তুকের ছাতার অবারিত আশ্রয় সামূহিক স্পিরিটটিকে আরও খানিক বাড়াইয়া দিল। অনুপস্থিত থাকিলেও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সমমর্মিতা দেখাইলেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। সমাজ যে সত্যই বহুবর্ণ আর বহুমতের সমাহার, একবর্ণের অত্যাচার নয়, আর এক বার সেই সত্য স্পষ্ট হইল।
মুশকিল হইল, আশার ঢেউয়ের মধ্যেই হতাশার চোরা স্রোত মিশিয়া থাকে। কলিকাতার জমায়েত ইতিমধ্যেই গুরুতর সব প্রশ্ন তুলিতেছে। যথেষ্ট মানুষ কি যোগ দিলেন? যাঁহারা যোগ দিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কি সব রকম শ্রেণি, গোত্র, পেশার লোককে দেখা গেল? কেবল শহুরে মানুষের বিলাসী প্রতিবাদের শখের প্রকাশেই ইহা সীমাবদ্ধ রহিল না তো? প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরই হতাশাপ্রদ হইবার আশঙ্কা। একমাত্র দিল্লির সমাবেশটি কিছুটা আশাপূরণের যোগ্য, বাকি কোনও শহরে নয়। তবে কিনা, অন্তত রাজধানীতে যে মুসলিম কিংবা দলিত এলিট-বহির্ভূত মানুষও আসিয়া পৌঁছাইয়াছিলেন, কেবল জেএনইউ প্রতিবাদীদের মধ্যে অংশগ্রহণকারীরা সীমাবদ্ধ থাকেন নাই, তাহা একটি কথা বলিয়া দেয়। বলিয়া দেয়, কেন্দ্রের কাছাকাছি অসহনের পীড়ন আরও কত যন্ত্রণাময় হইয়া উঠিতেছে। তবে সহানূভূতি বা সমানুভূতি যেহেতু কেবল স্থানিক অবস্থানের দ্বারাই নির্ধারিত হয় না, কলিকাতার হতাশা দিল্লি দিয়া ঘুচাইবার আশা কম।
অসহিষ্ণু হিন্দুত্ববাদের স্পর্ধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এই সবে শুরু, ক্রমে তাহা আকারেপ্রকারে বাড়িবে, এমন ভাবিতে পারিলে নিরাশাচক্র হইতে মুক্তি সম্ভব। কিন্তু এই একটি ‘ইভেন্ট’-এর পরই প্রতিবাদ যে নিজেকে হারাইয়া বসিবে না, এমন নিশ্চয়তা কি সত্যই আছে? বিশেষ করিয়া যখন রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলি এ সব লইয়া সময় ‘নষ্ট’ করিতে রাজি নহেন। রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর দড়ি টানাটানিতে তাঁহারা ভয়ানক ব্যস্ত। পনেরো বৎসরের নিরীহ মুসলিম বালককে গণপিটুনিতে হত্যা কিংবা গোরু-সহ বিচরণ করিবার অপরাধে সাধারণ গ্রামবাসীকে পিটাইয়া মারা, কিংবা গ্রামে মৃত গোরু দেখিবামাত্র মুসলিম প্রতিবেশীর বাড়ি সদলবলে চড়াও হইয়া হত্যার হুমকি: এই নিপীড়ন ও অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখন নাগরিক সমাজেরই দায় হইয়া উঠিয়াছে। বাহিরের রাজনীতি যখন সমাজের পাশে নাই, সমাজের ভিতর হইতেই বিরোধিতার রাজনীতিটি তৈরি করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy