Advertisement
E-Paper

রক্তের বদলে আর কত রক্ত? এর নিষ্পত্তি কোথায়

আমরা যেন এতগুলি তাজা প্রাণের বলিদান ভুলে না যাই। দেশের এই বিপদের সময়ে আমরা যেন নিজেদের মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার ভুল খেলায় লক্ষ্যভ্রষ্ট না হই। লিখছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তীআমরা যেন এতগুলি তাজা প্রাণের বলিদান ভুলে না যাই। দেশের এই বিপদের সময়ে আমরা যেন নিজেদের মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার ভুল খেলায় লক্ষ্যভ্রষ্ট না হই।

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৮

প্রেমের দিবসে পৃথিবী দেখল হিংসার আরেক রূপ। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় মারা গেলেন আটচল্লিশ জন সেনা জওয়ান। তাঁদের গাড়ির কনভয়ের মধ্যে নিজেদের গাড়ি নিয়ে ঢুকে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটাল জঙ্গিরা।

এর পর আর কী কী হল, এখন এই দেশের প্রায় সবাই তার বর্ণনা জেনে গিয়েছে। জইশ-ই-মহম্মদের মতো পাকিস্তানে আশ্রিত জঙ্গিগোষ্ঠী এই হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে। এই হামলার ফলে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। আর সেটাই স্বাভাবিক। একের পর এক এই রকম বহু হামলার ঘটনা দেখেছি আমরা। সহ্যেরও তো একটা সীমা থাকে!

এখন প্রশ্ন হল, দেশের মানুষের মনে হতেই পারে, আর কত রক্ত দেখতে হবে আমাদের? আর কত কত বার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে হবে? প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান এই সব জঙ্গিকে আশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ। তারা আর কত দিন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেওয়া সমস্ত প্রমাণ নস্যাৎ করে দেবে? তারা কেন মানুষের মৃত্যুকে রাজনীতির রঙে রাঙিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করবে? কেন আরেক বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ চিন এই জঙ্গি আশ্রয় প্রদানকারি দেশকে এখনও সাহায্য করে যাবে?

এই দেশের নাগরিক হিসেবে পুলওয়ামা জঙ্গি আক্রমণের কাণ্ডের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা খুব স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া। সহ্য করতে করতে এক সময়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। তাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হয়। সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। শিল্পীরা সফর বাতিল করছেন। ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের ক্রিকেটারদের ছবি। মোস্ট ফেভার্ড নেশনের সুবিধাও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ওই দেশটির থেকে। আরও নানান পদক্ষেপ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল— তাতে কি পাকিস্তান সরকার ও আইএসআই-এর সুমতি হবে? তাদের দ্বারা সংগঠিত এই জঙ্গি হামলা আদৌ কমবে?

আঘাত পেলে প্রত্যাঘাত করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটি অনেকেই উচ্চকণ্ঠে বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয়েছে, অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আর নয়। এ বার যুদ্ধ দিয়েই প্রতিবেশী দেশটিকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে, জঙ্গিসংগঠনকে এ ভাবে নিজেদের মাটিতে আশ্রয় দেওয়া বন্ধ না করলে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সমূহ বিপদ। কথাটা সত্যিই যে, এ ভাবে দিনের পর দিন জঙ্গি হামলা চলতে দেওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির আড়ালে লুকিয়ে থেকে একটা দেশ অন্য একটা দেশকে আঘাত করে যেতে পারে না। এর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতেই হবে।

কিন্তু সেই পদক্ষেপ কি যুদ্ধ?

‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ বলে চিৎকার করলেই কি যুদ্ধ লাগানো সম্ভব?

অতীতের নানান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-সহ, নিকট অতীতের মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বা আফগানিস্তানের যুদ্ধ আমাদের কী দেখিয়েছে? দেখিয়েছে যে, যুদ্ধ করে কিছুরই কোনও সমাধান হয়নি। বরং পরিস্থিতি আরও জটিল ও ঘোরালো হয়ে গিয়েছে। প্রচুর সৈন্য মারা পড়েছেন। যাঁরা কারও সন্তান, স্বামী, ভাই বা বাবা। আর প্রচুর সাধারণ নিরীহ মানুষ মারা গিয়েছেন যুদ্ধে।

আমরাও কার্গিল যুদ্ধ যাঁরা দেখেছি, তাঁরা জানি সেই যুদ্ধের সময়ে দেশের পরিস্থিতি কী হয়েছিল! তাই নিজের ঘরের ড্রইংরুমে বসে হয়তো ‘যুদ্ধ’ বলে রক্তগরম করা চিৎকার করা যায়, কিন্তু যাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে যুদ্ধের মতো ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাই জানেন এর ভয়াবহতা। আর এটাও ভুললে চলবে না যে, ভারত ও পাকিস্তান দু’টি দেশই পরমাণুশক্তিধর।

এ ছাড়াও প্রনিধানযোগ্য বিষয়, পুলওয়ামা-কাণ্ডে অন্যতম নিহত জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রীয়ের বক্তব্য। তিনি বলেছেন— যুদ্ধ না করাই ভাল। তিনি এটা বলতে পেরেছেন, কারণ তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে সংঘাতের পরিণামের ভুক্তভোগী। আসলে, ইতিহাস-সচেতন যে কোনও মানুষই জানেন, যুদ্ধে অগুন্তি মানুষের দুর্দশা ছাড়া আর কিছু হয় না। কেউ জেতে না। কেউ হারে না। বরং কিছু খারাপ লোক সেই যুদ্ধের ঘোলাজলে মাছ ধরে পরিস্থিতি আরও জটিল ও ঘোরালো করে তোলে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এত বড় একটা জঙ্গিহানায় মদত দিয়েও কি প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি প্রতি বারের মতো এ বারও রেহাই পেয়ে যাবে? তাদের বিরুদ্ধে কি আমরা কোনও ব্যবস্থাই নেব না? ভারত সরকার এর আগে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছে। তার জন্য কিন্তু সামগ্রিক যুদ্ধ করতে হয়নি। এ বারও কি সে রকম কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব? কিংবা আন্তর্জাতিক কূটনীতির বলে জঙ্গিদের আশ্রয়কারী ওই দেশটিকে কি চারদিক থেকে এমন করে চাপ দেওয়া সম্ভব যে, এ বার তারা সত্যি সত্যি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে বাধ্য হবে? আগেকার সময়ে সরাসরি যুদ্ধ না করেও কেল্লায় লুকিয়ে থাকা শত্রুকে বাইরে থেকে ঘিরে ধরে অবরোধের মাধ্যমে তার বেঁচে থাকার সমস্ত রসদ মাসের পর মাস বন্ধ করে দিয়ে শত্রুকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হত। এখানেও কি আন্তর্জাতিক কূটনীতি দিয়ে ওই রকম অবরোধ করে পাকিস্তানের শ্বাস বন্ধ করে দেওয়া যায় না? অবশ্য ইতিমধ্যেই এমন কিছু কিছু পদক্ষেপ করা হচ্ছে। চেষ্টা করে দেখাই যাক না, এতে যদি পাকিস্তান সরকারের হুঁশ ফেরে।

দেশে সামনেই লোকসভা নির্বাচন। ঠিক তার আগে এমন জঙ্গি আক্রমণ আরও নানান আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। আমরা আশা করি, এই মর্মান্তিক জঙ্গিহানা নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে ফয়দা লোটার চেষ্টা করবে না। কারণ, দেশের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা সমস্ত দলীয় রাজনীতি ও ব্যক্তিস্বার্থের উপরে। কথাটা প্রতিটি নাগরিকের বোধগম্য হওয়া খুব জরুরি।

ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী পুলওয়ামা হামলার সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিদের খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া চালু করে দিয়েছেন। এই হামলার মূল চক্রী জঙ্গিকে সোমবার সকালেই নিকেশ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। অচিরেই নিশ্চয়ই আরও নানা পদক্ষেপ করা হবে।

তবে জঙ্গি আক্রমণে নিহত বাবলু সাঁতরার স্ত্রীয়ের ওই কথাটি যেন আমরা ভুলে না যাই। যুদ্ধ যদি করতেই হয়, তবে তা যেন হয় শেষ ‘অপশন’। কিন্তু তার আগে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে অন্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে।

আমরা যেন এই এতগুলি তাজা প্রাণের বলিদান ভুলে না যাই। দেশের এই বিপদের সময় আমরা যেন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, হিংসা, প্রতিশোধ নেওয়ার ভুল খেলায় লক্ষ্যভ্রষ্ট না হই। এ সময় আরও বেঁধে বেঁধে থাকার সময়। যেন ভুলে না যাই একতাই আমাদের শক্তি।

সাহিত্যিক

Pulwama Terror Attack Kashmir Pulwama Attack পুলওয়ামা হামলা
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy