পুড়ে মৃত সেই শিশু। —ফাইল চিত্র
সরকারি চিকিৎসার ত্রুটি কত বৃহৎ, তাহা দেখাইল এক কন্যাশিশুর মৃত্যু। গোবরডাঙায় পাঁচ বৎসরের দিয়া দাস নিজের বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হইয়াছিল। অতঃপর যন্ত্রণাকাতর শিশুটিকে ছয়টি সরকারি হাসপাতাল অন্যত্র ‘রেফার’ করিয়াছে। লক্ষণীয়, সেইগুলির মধ্যে ছিল একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, এবং একটি শিশু হাসপাতাল। সামান্য প্রাথমিক শুশ্রূষা ব্যতীত অগ্নিদগ্ধ শিশুর যে সহায়তা পাইবার কথা, কোনও হাসপাতালই তাহা দিতে পারে নাই। সপ্তম হাসপাতালটি পরিজনদের বিক্ষোভ-চাপের মুখে শিশুটিকে ভর্তি করিয়াছে বটে, কিন্তু তত ক্ষণে শিশুটির বাঁচিবার আশা শেষ। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সে পাইয়াছে অনেক বিলম্বে, অপ্রয়োজনীয় কথার বর্ষণ তাহার পরিবারকে ছাড়ে নাই। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা পরামর্শ দিয়াছেন, আরও একটু ধৈর্য ধরিবার প্রয়োজন ছিল। শিশুটির পিতা প্রশ্ন করিয়াছেন, আর কত হাসপাতাল ঘুরিলে মেয়ে বাঁচিত? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। ইতিপূর্বে নাগেরবাজার বিস্ফোরণে মৃত বালকের ক্ষেত্রেও অভিযোগ ছিল, একাধিক বেসরকারি হাসপাতালে প্রত্যাখ্যানের কারণেই চিকিৎসায় বিলম্ব।
কোনও সভ্য দেশে ভাবা যায় না যে অগ্নিদগ্ধ রোগীকে এই ভাবে একাধিক হাসপাতাল প্রত্যাখ্যান করিতেছে। এই দেশের সুপ্রিম কোর্টও স্পষ্ট নির্দেশ দিয়াছিল, সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল কেহই জরুরি পরিষেবা প্রত্যাখ্যান করিতে পারিবে না। অথচ তাহা সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালগুলি সঙ্কটাপন্ন রোগীকেও ‘রেফার’ করিবার রোগমুক্ত হয় নাই। চিকিৎসকরা কিন্তু জানেন, অগ্নিদগ্ধ রোগীদের ক্রমাগত ‘রেফার’ করিলে তাহা জীবনসংশয় আরও বাড়াইয়া দেয়। প্রত্যাখ্যানের প্রধান কারণ, হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে সাধারণত রোগীর প্রথম স্থান হয় মেঝেতে। দগ্ধ রোগীকে সেখানে রাখা চলিবে না। দগ্ধের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত সরঞ্জাম-সহ সম্পূর্ণ পৃথক একটি ঘর, যাহাতে সংক্রমণ না হইতে পারে। জেলার হাসপাতাল তো বটেই, কলিকাতার বড় হাসপাতালগুলিতেও পৃথক ‘বার্ন ইউনিট’ অতি অল্প। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে সার্জারি বিভাগের কয়েকটি শয্যাকে কিছু আড়াল করিয়া দাহক্ষতের চিকিৎসা হয়। যে কয়টি হাসপাতালে বার্ন ইউনিট আছে, সেগুলিও রোগীর চাপে অসহায়। উপরন্তু শিশুদেহ দগ্ধ হইলে তাহার অস্ত্রোপচার ও শুশ্রূষা আরও জটিল, তাই শিশুরোগী গ্রহণে অধিক দ্বিধা করে হাসপাতাল। সরকারি ব্যবস্থায় শিশু-বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসকের অভাব সম্ভবত দিয়াকে বারংবার রেফার করিবার অন্যতম কারণ।
একটি শিশুর জীবনদীপ অবহেলায় নিবিয়া গেল। কাল অপর কোনও শিশুর একই সঙ্কট হইলে কী হইবে? আবার কি পরিবারকে যন্ত্রণাবিদ্ধ সন্তানকে কোলে লইয়া ছয়-সাতটি হাসপাতালে ঘুরিতে হইবে? অগ্নিদগ্ধ শিশুদের চিকিৎসা কোথায় গেলে মিলিবে, এই বিষয়ে সকল স্তরের হাসপাতালকে নির্দেশ দিতে হইবে স্বাস্থ্য দফতরকে। বার্ন ইউনিট, বিশেষত শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বার্ন ইউনিট কত প্রয়োজন, সেগুলিতে কত চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন, তাহার হিসাব করিয়া জোগান দিতে হইবে। তাহাও যথেষ্ট হইবে না, অতএব বেসরকারি হাসপাতালের জন্য দগ্ধের চিকিৎসা-নীতিও স্থির করিতে হইবে। অগ্নিদগ্ধের চিকিৎসাবঞ্চনা চলিতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy