Advertisement
E-Paper

শেষ বয়সে কবি এলেন বর্ধমানে

গাড়িতে কবি বিকেল চারটে নাগাদ দেবপ্রসন্নবাবুর বাড়িতে এসে পৌঁছন। সেখানে তখন শহরের প্রায় চারশো মানুষ উপস্থিত ছিলেন। বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাবও এই উপলক্ষে দেবপ্রসন্নবাবুর বাড়িতে এসেছিলেন। লিখছেন কবিতা মুখোপাধ্যায় প্রশ্নটা উঠছে এই কারণেই, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘বিশ্বপর্যটক’। সেই কবিগুরু শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেন এত বার কলকাতা যাতায়াত করলেন, অথচ তিনি কখনও বর্ধমানে আসেননি কেন?

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৯ ০১:৫০
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল ছবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল ছবি

বর্ধমান শহর থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। গাড়িতে মেরেকেটে ঘণ্টা দেড়েক। অথচ রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে লেগেছিল অনেকগুলি বছর। কিন্তু কেন? বর্ধমানবাসী কি তবে কবিগুরুর কীর্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না? নাকি, কবিগুরুর সঙ্গে কোথাও সূক্ষ্ম দূরত্ব তৈরি হয়েছিল সে কালের শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের? এই প্রশ্ন আজও গবেষকদের ভাবায়।

প্রশ্নটা উঠছে এই কারণেই, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘বিশ্বপর্যটক’। সেই কবিগুরু শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেন এত বার কলকাতা যাতায়াত করলেন, অথচ তিনি কখনও বর্ধমানে আসেননি কেন? তেমনই আরও একটি প্রশ্ন আমাদের ভাবায় তা হল শহর বর্ধমানও তাঁকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের আগে কোনও দিন আমন্ত্রণ জানায়নি কেন? অথচ এই বর্ধমানের বুকেই আয়োজিত হয়েছিল ‘অষ্টম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’।

কবিকে বর্ধমানে সম্মাননা জানানো হয় তাঁর প্রয়াণের মাত্র পাঁচ বছর আগে ১৯৩৬ সালে। তার আগে ১৩২১ বঙ্গাব্দে বা ১৯১৪-১৫ সাল নাগাদ বর্ধমানের মহারাজ বিজয়চাঁদ মহতাবের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শহরে রাজকীয় ভাবে আয়োজিত হয়েছিল পূর্বোল্লেখিত সাহিত্য সম্মেলন। এই সম্মেলনের আয়োজনের আগেই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার থেকেও বড় কথা, অষ্টম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। বিজয়চাঁদ যে শুধু সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন তাই নয়, তিনি নিজেও লেখক ছিলেন। বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে তাঁর প্রায় বাইশটি বই রয়েছে। কবিতা, গান, ধর্মতত্ত্ব, ভ্রমণ এবং সামাজিক— নানা বিষয়ে লিখেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং বিজয়চাঁদ দু’জনেই রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া সত্ত্বেও কবিগুরু এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না কেন, সে প্রশ্ন আজও গবেষকদের তাড়া করে।

সুকুমার সেন তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘বর্ধমান শহরের সাধারণ লোকের সাহিত্যের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল না।’ (দিনের পর দিন যে গেল)। তবুও এই সম্মেলনের ঢেউ যে বর্ধমানবাসীকে বেশ ভাল ভাবেই স্পর্শ করেছিল সে কথাও সুকুমার সেনের লেখা থেকে বোঝা যায়। আধুনিক কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, সেই সম্মেলনের আয়োজকদের একাংশের রবীন্দ্রনাথের প্রতি ‘অসূয়া বোধ’ কাজ করেছিল। সুকুমার সেনের কয়েকটি বক্তব্যে সে কথার প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘সভাপতি রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে ইঙ্গিতে কিছুটা চিপটেন কেটেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন সত্য, কিন্তু যাঁরা সেই পুরস্কার দিয়েছিলেন তাঁরা বাংলা সাহিত্য বোঝেন কতটুকু? রবীন্দ্রনাথ তো ‘মহাকাব্য’ লিখতে পারেননি। লিখেছেন কতগুলি ছোট ছোট কবিতা। ‘চুটকি’ বই আর কিছু না।’’

তবে সে বারের সেই বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন সুকুমার সেনদের মতো অনেকের কাছেই ছিল ‘শিবহীন দক্ষযজ্ঞ’-এর মতো। সেই সময়ের ভুল পরে শহর বর্ধমান শুধরে নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার আয়োজন করে। কবি কিন্তু বর্ধমান সম্পর্কে খুব উদাসীন ছিলেন এমনটা বলা যাবে না মোটেও। কেন না, ১২৯১ বঙ্গাব্দের শেষভাগে বর্ধমানে দুর্ভিক্ষ হয়। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ যুবক। তাঁর একটি গানে সে কালের বর্ধমানের দুঃখ, দুর্দশার প্রতিধ্বনি কোথাও যেন শোনা যায়, ‘দিন মাস যায়, বরষ ফুরায়/ ফুরাবে না হাহাকার?/ ওই কারা চেয়ে শূন্য নয়ানে/ সুখ-আশা-হীন নববর্ষ-পানে’

অবশেষে যাবতীয় মনোমালিন্য দূর করে প্রধানত বর্ধমানের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব দেবপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ১৯৩৬ সাল নাগাদ বর্ধমানে তাঁর একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। কবির বয়স তখন ৭৫। দেবপ্রসন্নবাবুর ভগ্নীপতি সত্যবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তেলিনিপাড়ার জমিদার পরিবারের সন্তান। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেবপ্রসন্নবাবুরও পরিচয় ঘটে। তাঁরই আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেবপ্রসন্নবাবুর বাড়িতে আসেন। তাঁর বাড়ি ছিল বর্ধমান রেলস্টেশন থেকে অদূরে বিবি ঘোষ রোডে। বর্তমানে অবশ্য সে বাড়ির কোনও অস্তিত্ব নেই। সেখানে ভবন সংস্কার করে নতুন আবাসন তৈরি হয়েছে। সেই বাড়ির প্রাঙ্গণেই স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে আয়োজন করা হয় সংবর্ধনা সভার।

পুরনো নথিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই সংবর্ধনার সুযোগ এসে যায় বর্ধমানের সামনে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই দু’টি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় গিয়েছিলেন। ১৪ ফ্রেব্রুয়ারি তাঁর শান্তিনিকেতনে ফেরার কথা ছিল। এই সংবাদটি পেয়েই দেবপ্রসন্নবাবু তৎপর হন কবিকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসতে। নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণেই সংবর্ধনা মঞ্চ তৈরি করেন। গাড়িতে কবি বিকেল চারটে নাগাদ দেবপ্রসন্নবাবুর বাড়িতে এসে পৌঁছন। সেখানে তখন শহরের প্রায় চারশো মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সব থেকে বড় বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল স্বয়ং বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব দেবপ্রসন্নবাবুর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। ওই দিন মহারাজা তাঁর ভাষণে ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের সুসম্পর্কের কথা তুলে ধরেন।

সেই সময়ের যে সব প্রবীণ নাগরিকেরা এখানে ছিলেন তাঁদের এবং তাঁদের উত্তরপুরুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কবি এই সংবর্ধনা সভায় এসেছিলেন ধুতি ও কালো টুপি পড়ে। স্থানীয় স্কুলের ছাত্রীরা এই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। রুপোর পাতের উপরে সংস্কৃতে লেখা একটি মানপত্র কবিকে দেওয়া হয়। সংবর্ধনা শেষ হলে কবিকে নিয়ে ও স্থানীয় কয়েক জন বিশিষ্ট ছবিও তোলেন। এই অনুষ্ঠানে শরীর ভাল না থাকায় কবি দীর্ঘ বক্তব্য রাখেননি। তবে নিজের আনন্দ ও খুশির কথা বলেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে ট্রেনে কবি শান্তিনিকেতনে ফিরে যান।

বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

Rabindranath Tagore রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Bardhaman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy