Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Racism

বৈষম্যের বিষক্রীড়া চলছেই

যে ক্রিকেট-খেলিয়ে দেশ বর্ণবৈষম্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে, তার নাম দক্ষিণ আফ্রিকা।

সূর্যশেখর দাস
শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:০৪
Share: Save:

সদ্যসমাপ্ত সিডনি টেস্টে ভারতীয় ক্রিকেটার যশপ্রীত বুমরা ও মহম্মদ সিরাজের উদ্দেশে বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য করেছেন কয়েক জন দর্শক। এই প্রসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অশ্বেতাঙ্গ অধিনায়ক অ্যাশওয়েল প্রিন্সের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে ছিলেন প্রিন্স। পার্থ টেস্টে দর্শকদের মন্তব্যে বিদ্ধ হন তিনি এবং আরও দু’জন অশ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার। বিষয়টা দলের নেতৃত্বকে জানিয়েওছিলেন। কিন্তু পাল্টা শুনতে হয়, কয়েক জন কী বলল, তা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর দরকার নেই! সেই অপমান আজও ভুলতে পারেননি সংবেদনশীল প্রিন্স।

ক্রিকেট হল ‘জেন্টলম্যানস গেম’। অথচ, তার জন্মস্থান ইংল্যান্ডেই অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি বিভিন্ন সময়ে বিদ্রুপাত্মক এবং অসম্মানজনক শব্দ ছুড়ে দেন শ্বেতাঙ্গরা। প্রাক্তন ইংরেজ কৃষ্ণাঙ্গ টেস্ট ব্যাটসম্যান মাইকেল কারবেরি বলেছিলেন, বর্ণবৈষম্যের ধাক্কায় তাঁর কেরিয়ার মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার রোল্যান্ড বুচার জানান, ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বিদ্বেষের চোরা স্রোত এখনও বয়ে চলেছে। জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কৃষ্ণাঙ্গ ফাস্ট বোলার জোফ্রা আর্চারের উদ্দেশেও কটু মন্তব্য করা হয়েছে।

অবশ্য যে ক্রিকেট-খেলিয়ে দেশ বর্ণবৈষম্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে, তার নাম দক্ষিণ আফ্রিকা। এর ধাক্কায় তাদের জাতীয় দল এক সময় প্রায় ২১ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত ছিল। এই নির্বাসনের সঙ্গে আবার ইংল্যান্ডের যোগ রয়েছে। স্বদেশের হয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার কথা ছিল বেসিল ডি’অলিভেইরা-র, কিন্তু অশ্বেতাঙ্গ হওয়ায় সুযোগ পাননি, শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬৮ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ইংল্যান্ড দলে জায়গা পান ডি’অলিভেইরা। ইংল্যান্ড দলে তাঁর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তীব্র আপত্তি জানায় দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ-পরিচালিত সরকার। সফরই বাতিল হয়ে যায়! বিদ্বেষবিষ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা দেখে ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক খেলা থেকে নির্বাসিত করে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা আইসিসি। আসলে, যে দেশে বছরের পর বছর অগণিত নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ গায়ের রঙের কারণে অত্যাচারিত হয়ে এসেছেন, যে দেশে কালো চামড়ার মানুষেরা ক্রিকেট খেলার সুযোগই পেতেন না, সেখানকার জাতীয় ক্রিকেট দল এই ভয়ানক বিষে আক্রান্ত হলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সার্বিক ভাবেও দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজে দীর্ঘ দিন ধরে যে ভয়ানক বর্ণবৈষম্য ছিল, সেই কাহিনির সঙ্গে বহু মানুষই পরিচিত।

অবশেষে বিশ শতকের শেষ প্রান্তে, ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে মাখায় এনতিনি-র— প্রোটিয়াদের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ আফ্রিকা কিন্তু সেই উনিশ শতক থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে!

এ প্রসঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার কথা আসবেই। আধুনিক দক্ষিণ আফ্রিকার রূপকার বর্ণবৈষম্যের অন্ধকার অতিক্রম করে রামধনুর মতো রঙিন দেশ দেখতে চেয়েছিলেন; সেখানে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ দুই গোষ্ঠীই মিলেমিশে থাকবে। শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা ম্যান্ডেলাকে ২৭ বছর জেলে বন্দি করে রেখেছিলেন। ম্যান্ডেলা কিন্তু তাঁদের প্রতি অন্ধ আক্রোশ তৈরি করেননি। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, ১৯৯৪ সালে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। এবং ঠিক করেন, ১৯৯৫ সালে তাঁর দেশে অনুষ্ঠিত হতে চলা রাগবি বিশ্বকাপে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বিভেদরেখা মুছে দেবেন। সে সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় মূলত সাদা চামড়ার মানুষেরাই রাগবি খেলতেন, দূরে সরিয়ে রাখা হত কালো মানুষদের। সমাজে বিভাজনের অন্যতম চিহ্ন ছিল রাগবি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলা প্রকাশ্যে সেই শ্বেতাঙ্গ দলকে সমর্থন করেন, দেশের কৃষ্ণাঙ্গদেরও তা করতে বলেন। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ চলাকালীনই অবিশ্বাস্য ভাবে দুই গোষ্ঠীর বিভেদরেখা মুছে যেতে থাকে। এক সূত্রে বাঁধা পড়ে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা। আর দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনে অনুপ্রাণিত দল বিশ্বকাপ জিতে নেয়! এই জয় দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে তো বটেই, সার্বিক ভাবে খেলার ময়দানেও এক অবিস্মরণীয় উদাহরণ তৈরি করে দেয়। ম্যান্ডেলার উদ্যোগে রাগবি যা পেরেছিল, ক্রিকেট কেন আজও তা পারবে না?

আন্তরিক ভাবে চাইলে যে অনেক কঠিন সমস্যারও সমাধান করে ফেলা যায়, তা দেখিয়েছেন ম্যান্ডেলা। যে দর্শকেরা বুমরা-সিরাজদের অপমান করলেন, তাঁদের উদ্দেশে চমৎকার বার্তা দিয়েছেন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার শিখা পাণ্ডে। তাঁর মতে, কোভিডে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে যাঁরা স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁরা অত্যন্ত ভাগ্যবান। সেই খেলাকে ‘সেলিব্রেট’ করা উচিত, সম্মান জানানো উচিত, ‘অ্যাবিউজ়’ করা ঠিক নয়। সত্যিই তো, ক্রিকেটারদের খারাপ কথা বললে তা তো ক্রিকেটের গায়েও লাগে। ‘অত্যাধুনিক’ একুশ শতকেও কুড়িটা বছর কেটে গেল। বর্ণবিদ্বেষীরা এ সব কথা আর কবে বুঝবেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Racism India Australia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE