Advertisement
E-Paper

আক্রমণই আত্মরক্ষার অস্ত্র

শুধু ‘ষড়যন্ত্র’ নয়, তিনি বললেন, দেশের ভেতরে মহাজোট বানাতে না পেরে রাহুল মন দিয়েছেন ‘আন্তর্জাতিক মহাগঠবন্ধন’-এ। এর পর বিদেশি শক্তিই ঠিক করবে কে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। দেশকে বিপন্ন করছেন রাহুল গাঁধী!

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
‘স্বচ্ছ’: বিজেপির বৈঠকে সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লি, ৮ সেপ্টেম্বর। পিটিআই।

‘স্বচ্ছ’: বিজেপির বৈঠকে সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লি, ৮ সেপ্টেম্বর। পিটিআই।

রাফাল-কাণ্ডে একটা বিষয় পরিষ্কার। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণত যে অভিযোগগুলো বিরোধীরা তুলে থাকেন, তার প্রতিটিই এই কাহিনিতে উজ্জ্বল ভাবে উপস্থিত। মোদী সরকারের প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, সব কাজ চুপি চুপি সারা। খোলামেলা কথাবার্তায় তাঁদের কেবল অনীহা নয়, বিশেষ আপত্তি আছে বলে মনে হয়। সকলের চোখের আড়ালে লুকিয়ে কাজ করতেই তাঁরা পছন্দ করেন। দেশের অর্থনীতিকে যখন এঁরা ‘দুর্নীতিমুক্ত’ করতে চান, চুপচাপ সব ব্যবস্থা সেরে রাতারাতি ঘোষণায় গোটা দেশের পিলে চমকে দেন। দেশের প্রতিরক্ষা ‘শক্ত করতে’ এঁরা যখন যুদ্ধবিমান কেনেন, তখনও কাকপক্ষী জানতে পারে না কখন কোথায় কী চুক্তি সই হল। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ফ্রান্সে যখন জাতীয় প্রতিরক্ষার স্বার্থে রাফাল চুক্তিটি হয়েছিল, তা নাকি দুই দেশের সরকারি বৈঠকে ঘটেনি, ঘটেছিল প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদের নিভৃত বৈঠকে। তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর সে সময়ে ছিলেন গোয়ায়। তিনি বা বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বা বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, কেউই নাকি রাফাল চুক্তি বিষয়ে কিছু জানতেন না। নেতারা আজ বলছেন, রাফাল ‘গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট’ চুক্তি। তার মানে আমাদের ধরে নিতে হবে ভারতের ক্ষেত্রে গভর্নমেন্ট বলতে এক ও একক প্রধানমন্ত্রী মোদীই, আর কেউ নয়। প্রধানমন্ত্রী যা করবেন, দেশের জন্য সেটাই শ্রেষ্ঠ, এটা সকলকে মেনে নিতে হবে, উপায় কী।

কেউ যদি সন্দেহ করে, যদি জানতে চায়, মশাই ব্যাপারটা কী বলুন তো, মনে হচ্ছে গোলমাল— সঙ্গে সঙ্গে উল্টে প্রশ্নকারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন সকলে। মোদী সরকারের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এটাই। আক্রমণই আত্মরক্ষার সেরা পথ, এই নীতি তাঁরা এমন অক্ষরে অক্ষরে মানেন যে আক্রমণের উগ্রতা দেখেই অনুমান করা চলে, আত্মরক্ষা জরুরি করার মতো ফাঁকফোকর আছে কতখানি। এই যেমন, রাফাল চুক্তির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছে যারা— সরকার পক্ষ বলে দিয়েছে যে, এ সব কিছু না, আসলে চলছে ‘মোদী হটাও’ ক্যাম্পেন! যখনই প্রশ্ন উঠল কী ভাবে অনিল অম্বানীর কোম্পানিই সরকারি চুক্তির এক ও একমাত্র দেশীয় বরাত-প্রাপক হল, উল্টো অভিযোগে পাড়া কাঁপিয়ে দিলেন বিজেপি নেতারা। পাল্টা প্রশ্ন উঠল, ইউপিএ আমলে চুক্তি কেন বাতিল হল, তা কি তাঁরা জানেন না? রাহুল গাঁধীর ভগ্নীপতি রবার্ট বঢরার বন্ধুটি চুক্তিতে ভাগ পাননি বলেই না সে চুক্তি বন্ধ হয়েছিল! রবার্টকে কি ওই জন্যই লন্ডনে ফ্ল্যাট কিনে দেননি সেই বন্ধু? অর্থাৎ, অম্বানী-মোদী জুটির দিকে আঙুল তুললেই উল্টো আঙুল তাঁরা ওঠাবেন গাঁধী পরিবারের দিকে, বিজেপি মুখপাত্র বলবেন, দেখুন না, রবার্ট জেলে যাচ্ছেনই, আজ নয়তো কাল! কিন্তু বিরোধীরা বলবেন, প্রশ্নটা তো এই নয় যে, রবার্ট জেলে যাচ্ছেন কি না। যে চুক্তি হয়নি তার সম্ভাব্য ফলপ্রাপককে নিয়ে তো কোনও প্রশ্ন ছিল না, বরং যে চুক্তি হয়েছে, তার নিশ্চিত অংশীদার অনিল অম্বানীকে নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। সবটা গুলিয়ে দেওয়ার জন্য এখন হল্লা তুলতেই হবে!

আর কে না জানে, হল্লা তোলা ও ছড়ানোর সর্বোত্তম উপকরণ— পাকিস্তান। এই একটি শব্দ উচ্চারণ করলেই তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’দের রক্তচাপ বেড়ে যায়, গায়ে জ্বলুনি ধরে, এটাই বিজেপির তুরুপের তাস, আর এটাই তাদের সরকারের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য। সরকারের বিরোধিতা মানেই রাষ্ট্রের বিরোধিতা, আর রাষ্ট্রের বিরোধিতা মানেই অ্যান্টি-ন্যাশনাল, আর তার মানেই পাকিস্তানের চর! সুতরাং রাহুল গাঁধী যদি জানতে চান, রাফাল চুক্তিতে বিমানপ্রতি দাম এত বেশি পড়ছে কেন, আগের চুক্তিতে তো এত দাম পড়েনি, কেনই বা ১২৬টার জায়গায় ৩৬টা বিমান কেনার সিদ্ধান্ত হল, তখন সরকারের বুঝতে এক ফোঁটাও বাকি থাকে না যে রাহুল আসলে পাকিস্তানের চর। কেননা যুদ্ধবিমানের দামটা বলে দিলেই তো সকলে (অর্থাৎ পাকিস্তান) বুঝে ফেলবে কী কী ‘ফিচার’ তার মধ্যে থাকছে। (সমরাস্ত্র বিশারদরা যদিও বলছেন, দাম থেকে বিমানের গুণাগুণ বোঝা সম্ভব নয়!) অর্থাৎ, বর্তমান সরকারি মতে, বিরুদ্ধ প্রশ্ন = পাকিস্তানের চামচাগিরি! দলীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র তাই প্রেস কনফারেন্স-এ বিশদ করে বললেন রাহুলের প্রশ্নের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগের কথা।

চতুর্থত, প্রায় কোনও বিজেপি নেতাই অভিযোগ তোলা বা ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় তথ্য-প্রমাণ বস্তুটির তোয়াক্কা করেন না। ফলে হামেশাই দেখা যায়, মন্ত্রীরা যা বলছেন, সেটা ঠিক নয়, আর সেটা যে ঠিক নয়, দ্রুত তার প্রমাণও মিলে যায়। কিন্তু তাঁরা নিতান্ত হেলদোলহীন, তাঁদের প্রধানমন্ত্রীও নির্বিকার। যেন জেনেই গিয়েছেন, সত্যি কথা বলাটা আদ্যিকালের ‘বোগাস’ জিনিস, স্মার্ট ফোনের মতো এখন ‘স্মার্ট রাজনীতি’র যুগ— ভোটের ব্যবস্থাটা পাকা করে বাকি সব যেমন-ইচ্ছে-তেমন। এই ক’দিন আগে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী সর্বসমক্ষে বললেন, রাফাল চুক্তি থেকে সরকারি কোম্পানি হিন্দুস্থান এরোনটিকস লিমিটেড বা হ্যাল বাদ গেল কারণ তাদের যুদ্ধবিমান বানানোর মতো ক্ষমতা নেই। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাল-এর প্রাক্তন অধিকর্তা প্রকাশ্যে জানালেন, না, এটা একদম ঠিক নয়, হ্যাল এ কাজ করার জন্য দিব্যি প্রস্তুত ছিল, তাও কেন তাদের বাদ দেওয়া হল তারা জানে না। সরকারি কোম্পানি সম্পর্কে এত ভুল দাবি করার পরও কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী চুপচাপ। সব চেয়ে আশ্চর্য— যখন রিলায়্যান্স এবং ভারতের প্রতিরক্ষা দফতর একই সুরে বলছে যে অম্বানীর কোম্পানিকে নাকি বেছে নিয়েছে ফরাসিরাই— প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ তখনই ফাঁস করে দিলেন যে না, ফ্রান্সের দিক থেকে নয়, ভারতের পক্ষ থেকেই রিলায়্যান্স-এর নাম নিয়ে জোরাজুরি করা হয়েছিল। কী কাণ্ড! এ তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল খাওয়া! অথচ এর পরও নিঃশঙ্ক নেতা-মন্ত্রীরা পরবর্তী বাগাড়ম্বরে মন দিলেন। ভুল-ঠিক সত্য-মিথ্যা সবই যেন মায়া, একটি বস্তুই সদাসত্য— ভোটের প্রচার।

ফলে যদিও অনিল অম্বানীর যে কোম্পানি রাফালের বরাত পেয়েছে, এ বিষয়ে তার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, যদিও নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্রীকর সে বারের ফ্রান্স সফরে না গেলেও গিয়েছিলেন অনিল অম্বানী নিজেই— ভোপালের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের দিকে চোখ রেখে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ জানিয়ে দিলেন: যা কিছু তাঁদের বিরুদ্ধে শোনা যাচ্ছে, সবই শত্রুপক্ষের গুজব। ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ (বা বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাকরঁ) যা বলছেন, শুনে বোঝাই যাচ্ছে, রাহুল গাঁধী ওঁদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করেছেন— সাংবাদিক বৈঠকে বললেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিংহ শেখাওয়াত। ‘কৃষিমন্ত্রী’ বলে ভ্রুকুঞ্চন? করবেন না। এই সরকারের ব্যাপারই আলাদা। সকলের চোখের আড়ালে চুক্তি করেন একা প্রধানমন্ত্রী, তার পর বিপক্ষের আক্রমণ সামলাতে একের পর এক যে মন্ত্রীরা অবতীর্ণ হন (আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ, অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, কৃষিমন্ত্রী শেখাওয়াত), তাঁদের সঙ্গে প্রতিরক্ষার যোগ নেহাত মহাজাগতিক!

অবশ্যই সকলকে ছাপিয়ে যান অমিত শাহ। শুধু ‘ষড়যন্ত্র’ নয়, তিনি বললেন, দেশের ভেতরে মহাজোট বানাতে না পেরে রাহুল মন দিয়েছেন ‘আন্তর্জাতিক মহাগঠবন্ধন’-এ। এর পর বিদেশি শক্তিই ঠিক করবে কে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। দেশকে বিপন্ন করছেন রাহুল গাঁধী!

নাঃ, এইখানে এসে রাফাল আমাদের এত দিনকার চেনাজানা বিজেপি ন্যারেটিভকেও ছাপিয়ে যায়। প্রতিবেশী দেশ ছাড়িয়ে এক লাফে একেবারে খাঁটি ইউরোপীয় গঠবন্ধন!

জাতীয়তাবাদী আবেগ হাহাকার করে উঠবেই। সত্যিই তো। যে নেতা একেবারে একার সিদ্ধান্তে চলেন, কোনও প্রশ্ন যাঁকে করা যায় না, প্রশ্ন করলেও উত্তরে আক্রমণ ছাড়া কিছু মেলে না, যিনি নিজ দায়িত্বে ১২৬-এর বদলে ৩৬টি যুদ্ধবিমান বেশি দামে কেনা সাব্যস্ত করে পছন্দসই ব্যক্তির সান্নিধ্যে চুপিচুপি দেশের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কিসের এত গোলযোগ? তিনি আছেন বলেই না ভারত ‘স্বচ্ছ’ হচ্ছে?

Rafale Amit Shah Narendra Modi Rahul Gandhi Rafale Deal Francois Hollande
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy