মে দিবসের প্রস্তুতি। ফাইল ছবি
এই দিনটি বার বার ফিরে আসে। আর মনে করিয়ে দেয় আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। যেমন, এ বারের মে দিবস মনে করিয়ে দেয় অর্থনীতির এক ভয়াবহ পেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। এক দিকে, বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বেকার কাজের আশায় দিন গুনছে আর অন্য দিকে, সাম্প্রতিক সময়ে সঙ্কুচিত হচ্ছে দেশের কর্মসংস্থান। তা সে জেট বিমান সংস্থার ২২ হাজার কর্মীর অনিশ্চিত ভবিষ্যত কিংবা ফাস্ট ফ্লাইট ক্যুরিয়ার সংস্থার প্রায় ১০ হাজার কর্মীর কাজ হারানো। এ বার আবার ‘মে দিবস’ পড়েছে লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে । নির্বাচনী জনসভায় জাতীয় ও রাজ্যস্তরে নেতা-নেত্রীরা কর্মসংস্থান নিয়ে প্রচুর তথ্য পরিবেশন করছেন। যার মধ্যে অধিকাংশেরই কোনও ভিত্তি নেই। কেউ ক্ষমতায় আসার জন্য বলছিলেন, বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। আবার কেউ বলছেন, রাজ্যে নাকি ৮১ লক্ষ কর্মসংস্থান ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এ যেন এক বাজারগরম করার প্রতিযোগিতা! আর একটি আঙ্গিকে প্রতি দিন প্রতিযোগিতা চলছে। সেটি হল, সমাজের মূল সমস্যা থেকে নাগরিকদের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতা। কেন কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না? কেন বেকাররা কাজ পাচ্ছে না?—এ সব প্রশ্নের বদলে রাজনৈতিক পরিসরে ‘তু চোর না, মু চোর’ জাতীয় বিতর্কই প্রধান হয়ে উঠছে। সারদা, নারদা নাকি নীরব মোদী, মেহুল চোক্সী কোন কেলেঙ্কারি বড়! সবই এক সস্তা রাজনীতির মোড়কে পরিবেশন করা হচ্ছে।
আজকের দিনটিতে তাই আমরা একটু ফিরে তাকাতে পারি। একটু খতিয়ে দেখতে পারি, জাতীয় ও রাজ্যস্তরের সরকারি তথ্যভাণ্ডারের দিকে। আর সেই তথ্য দেখাচ্ছে কর্মসংস্থানের করুণ চিত্রটিকে। জাতীয় স্তরে ২০১৭-’১৮ অর্থবর্ষে বেকারত্বের হারছিল ৬.১ শতাংশ। যা কিনা গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। যদিও ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসকে এই তথ্যটি প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। সূত্রে থেকে এই তথ্যটি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কর্মসংস্থানের এই ভয়াবহ তথ্যটি জনসমক্ষে আসতে দেননি। এর প্রতিবাদে ‘ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল কমিশন’-এর দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ইস্তফাও দেন। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপাত্র জানান, ‘ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল কমিশন’-এর এই রিপোর্ট অসম্পূর্ণ। সম্পূর্ণ তথ্য বিশ্লেষণের পরে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাওয়া যাবে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এর মধ্যে নির্বাচনী পর্ব শেষ হয়ে যাবে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
১৯৭১ সালের পরে এই প্রথম বেকারত্বের হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল ৫.৮ শতাংশ। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই উচ্চ বেকারত্বের হার মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তা বলে, এই ২০১৮ সালে ৬.১ শতাংশ বেকারত্ব হারের চিত্রটি কিছুতেই মেলানো যায় না। মেলানো যায় না, কারণ, ক্ষমতার আসার আগে নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান করবেন। ক্ষমতায় আসার পরে প্রধানমন্ত্রী কর্মসংস্থান কেন্দ্রীক অনেক প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন দু’কোটি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে। এখন সেই প্রকল্পগুলির দিকে একটু চোখ বোলানো যাক।
প্রথমেই বলা যাক ‘মুদ্রা যোজনা’র কথা। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল, বহু মানুষের কাছে ঋণ পৌঁছে দেওয়া যাতে তাঁরা স্বনিযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনার ওয়েবসাইট বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৬.৬ কোটি ঋণের দরখাস্ত মঞ্জুর হয় এবং ৭.৮ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। অঙ্কের হিসেবে মাথাপিছু ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৯৬৪ টাকা। খুবই ক্ষুদ্র সংস্থা ছাড়া এই যৎসামান্য ঋণে কোনও লাভ হয় না। ফলে এই প্রকল্পে ঠিক কত কর্মসংস্থান হয়েছে, সেই বিষয়ে ওয়েবসাইট নীরব।
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য প্রকল্পটি, ‘প্রধানমন্ত্রী কুশল বিকাশ যোজনা’ যা কি না ‘স্কিল ইন্ডিয়া প্রোগ্রাম’ নামে খ্যাত। এ প্রকল্পে শিক্ষিত যুবক, যুবতীদের শিল্প সহায়ক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কারিগরি শিক্ষা দেওয়ার কথা। কিন্তু এই প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-এর এপ্রিল অবধি ২৯.৮৬ লক্ষ যুবক-যুবতী অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে মাত্র ৩৪.৫ শতাংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। আবার এই ৩৪.৫ শতাংশ যুবক-যুবতী সম্পূর্ণ নতুন ভাবে কাজ পেয়েছেন কিনা সেই কথা ওয়েবসাইটে কিন্তু উহ্যই থেকে গিয়েছে।
শেষে আসি ‘প্রধানমন্ত্রী এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন প্রোগ্রাম’-এর কথায়। এই প্রকল্পটি ‘মুদ্রা যোজনা’ থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন, কিন্তু উদ্দেশ্য একই। এই প্রকল্পের আওতায় স্বনিযুক্ত ব্যবসার জন্য ঋণের মূল টাকাটা দিয়ে থাকে ব্যাঙ্ক আর ব্যবসা করার মার্জিন-মানি দিয়ে থাকে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১৬ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পে ১২.৩ লক্ষ দরখাস্ত জমা পড়েছে। সেখান থেকে ১.৩৩ লক্ষ প্রস্তাব মঞ্জুর হয়। এই ১.৩৩ লক্ষ কর্ম পরিকল্পনার জন্য ৭.৯ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তার মানে দাঁড়ায় যে এক একটি কর্ম পরিকল্পনার জন্য মাত্র সাতটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে! কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ৩৬৪৯ কোটি টাকা মার্জিন-মানি হিসেবে এই প্রকল্পে খরচ করেছে। ফলে হিসেব বলছে, এক একটি প্রস্তাবের জন্য মাথাপিছু ২.৭ লক্ষ টাকা মঞ্জুর হয়েছে।
এই সব তথ্য একটি দিককেই নির্দেশ করছে। বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি শুধু মুখের কথা। এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই। উপরন্তু, প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, মাত্র কয়েকশো সরকারি চাকরির জন্য লক্ষ লক্ষ আবেদন জমা পড়ে। এমনকি, মৃতদেহ সৎকারের ডোমের পদের জন্য পিএইচডি -ধারী আবেদন করছেন ! সরকারি দফতরে পিয়নের পদের জন্য লক্ষ লক্ষ উচ্চশিক্ষিত আবেদনকারীর লাইন পড়ে যাচ্ছে।
এক দিকে, কর্মসংস্থানের এই করুণ দশা, অন্য দিকে, দিনের পর দিন সমাজে আয়ের বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, জাতীয় আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই ভারতের ধনী কর্পোরেটের হস্তগত। আর দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের কাছে আছে জাতীয় আয়ের মাত্র ০.২ শতাংশ। আয়ের এই বিপুল বৈষম্য সমাজ ও দেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কারণ, বৈষম্য সমাজের স্থিতিশীলতা ও শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক।
আমাদের রাজ্যের ছবিও আশাব্যঞ্জক নয়। বর্তমান সময়কালের মধ্যে নতুন কোনো বৃহৎ শিল্পের দেখা মেলেনি। উপরন্তু মেলা, উৎসব, খেলাধুলো, ক্লাব থেকে পুজো কমিটি সব কিছুর পিছনে অর্থব্যয় চলছে। বার্ষিক শিল্প সম্মেলন হচ্ছে। কিন্তু এর থেকে বৃহৎ শিল্পের দেখা মিলছে কই? এমনকি, এসএসসির মতো পরীক্ষায় পাশ করার পরেও চাকরি নিশ্চিত নয়। বলা ভাল, মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত।
সূত্রের খবর, এই বর্ধমান শহরেই কিছু দিনের মধ্যে এক অনলাইনে খাবার ডেলিভারির বহুজাতিক সংস্থায় ছেলেদের সংখ্যা অত্যাধিক হারে বেড়ে গিয়েছে। এঁদের একটি বড় অংশ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। অন্য দিকে, শহরে টোটো চালকের সংখ্যাও খুব দ্রুত হারে বেড়েছে। এ সবই সংগঠিত ক্ষেত্রে নতুন কাজের অভাব আর বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলের একের পর এক কল, কারখানার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফল। সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মহীনতার কারণে শিক্ষিত সমাজও হতাশাগ্রস্ত। তাই এই ‘মে দিবসে’ কাজের দাবিটিকেই আরও জোরাল করে তুলতে হবে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy