আত্মবিশ্বাসে কি ঘাটতি রয়েছে? না হলে গুজরাত নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে ফের রাম মন্দির নিয়ে সুর চড়ানোর দরকার পড়ল কেন? অযোধ্যার বিতর্কিত জমি রাম মন্দিরের ভাগে পড়বে, নাকি বাবরি মসজিদের খাতায় জমা হবে, তা এখন আদালতের বিচারাধীন। বিষয়টি নিয়ে যে এই মুহূর্তে গোটা দেশে জোর চর্চা, তেমন নয়। কিন্তু সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বেশ আচম্বিতেই চড়া সুর ধরলেন। অযোধ্যায় শুধুমাত্র রাম মন্দিরই হবে, অন্য কোনও কাঠামো নয়— অঙ্গীকারের ঢঙে উচ্চারণ করলেন। এ কথা ঠিক যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি ভিন্ন অস্তিত্ব। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, হিমশৈলের শিখর এবং হিমশৈলের নিমজ্জিত ভাগ পরস্পরের থেকে যতটা অভিন্ন, বিজেপি এবং সঙ্ঘও ততটাই অভিন্ন। তাই গুজরাত নির্বাচনের মুখে সঙ্ঘ-প্রধানের কণ্ঠে রাম মন্দির গড়ার অঙ্গীকারে বিরোধী শিবির মেরুকরণ তত্ত্ব খুঁজবেই। বিজেপি-ও অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই সে তত্ত্ব নস্যাৎ করবে।
শাসকের কথা সত্য? নাকি বিরোধীর দাবি অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য? এই প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণের পথে হাঁটতে হবে। ভারতীয় রাজনীতির গত কয়েক দশকের গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখা গেলে সে বিশ্লেষণ শক্ত কিছু নয়।
আরও পড়ুন
অযোধ্যায় মন্দিরই হবে, অন্য কিছু নয়: হুঙ্কার ভাগবতের
অযোধ্যাকে ঘিরে টানাপড়েনের ইতিহাস দীর্ঘদিন ধরেই বহতা। রাম মন্দির না বাবরি মসজিদ— এই প্রশ্ন তুলে দীর্ঘ এবং তীব্র সঙ্ঘাতে দুই শিবির। দীর্ঘ দিন ধরে এই সঙ্ঘাত বহতা, কারণ, রাম মন্দির-বাবরি মসজিদের টানাপড়েন আলোচনায় উঠে এলেই গোটা দেশে হিন্দু ভোটকে মেরুকৃত করা সুবিধাজনক। উল্টো দিকে, বিজেপি বিরোধী বা সঙ্ঘ বিরোধী রাজনৈতিক স্রোতগুলোকে একত্র করাও সহজ। বিজেপির তরফে বার বার সময় মতো অযোধ্যা বিতর্ক উস্কে দেওয়ার চেষ্টা দেখা গিয়েছে। কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। অযোধ্যাকে ঘিরে মেরুকরণ দু’দিকেই হয়। কিন্তু বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের দিকে থাকার সুবিধা পায়। একাধিক নির্বাচনে ব্যবহৃত সেই তাস যখন বিজেপির জন্য অত্যম্ত গুরুত্বপূর্ণ গুজরাত নির্বাচনের আগেও ঘুরপথে সামনে আসার চেষ্টায়, তখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে নিতান্ত সমাপতন বলে ধরে নিতে পারবেন না।
গুজরাতের নির্বাচন এর আগেও মেরুকরণের উপরে দাঁড়িয়েই হয়েছে। কখনও গোধরা কাণ্ড ও তার পরবর্তী হিংসাকে কেন্দ্র করে হওয়া মেরুকরণ। কখনও গুজরাতি অস্মিতার নামে হওয়া মেরুকরণ। এ বারের নির্বাচনে সে সব অস্ত্র যেন কিছুটা ভোঁতা। বণিক-বহুল গুজরাতে জিএসটি নাকি বড়সড় ক্ষতস্থান তৈরি করেছে। জিএসটি-র হার সংশোধন করে সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু হীনবল হয়ে পড়া গুজরাতি অস্মিতা তাতে ফের বলশালী হয়ে উঠেছে, এমন ভরসা মিলছে না। তাই আরও বড় কোনও অস্মিতা জরুরি ছিল বিজেপির জন্য। শঙ্খনাদটা শোনা গেল সঙ্ঘের মঞ্চ থেকে। অযোধ্যা বিতর্ককে উস্কে দিয়ে হিন্দু অস্মিতা জাগিয়ে তোলার প্রয়াস হল। আবার বলছি, এ নিতান্ত সমাপতন নয়।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মঞ্চ থেকে মোহন ভাগবতের হুঙ্কার কতটা ‘আদর্শ-প্রণোদিত’, সে চর্চায় সঙ্ঘ এবং বিজেপি মেতে উঠতেই পারে। কিন্তু এ হুঙ্কার কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বুঝতে আর বেশি কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন পড়ছে না।