Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
ব্রিগেডে উত্তরণের পদধ্বনি?

বঙ্গের ভোট-ভবিষ্যৎ আঁচ করেই বিরোধী শিবিরে ‘দামি’ মমতা

মমতার বক্তব্য ছিল, যেখানে যে রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে যে দল প্রধানত শক্তিশালী সেখানে তারা লড়াই করবে এবং অন্যেরা তার পিছনে দাঁড়াবে। সে ক্ষেত্রে যেখানে কংগ্রেস বড় শক্তি, সেখানে প্রাধান্য পাবে তারাই। সেই যুক্তিতে তিনি এখনও স্থিত।

সেই ১৯৯২ সাল থেকেই একার জোরে ব্রিগেড সমাবেশ করার হিম্মত দেখিয়ে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।— ফাইল চিত্র।

সেই ১৯৯২ সাল থেকেই একার জোরে ব্রিগেড সমাবেশ করার হিম্মত দেখিয়ে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।— ফাইল চিত্র।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

আজ রাত পোহালেই মমতার ব্রিগেড সমাবেশ। এমন সমাবেশ এর আগেও তিনি করেছেন। এবং ভিড়ে ভরিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ১৯৯২ সালে তিনি যখন প্রদেশ যুব কংগ্রেসের প্রধান, তখনই প্রথম একার জোরে ব্রিগেড সমাবেশ করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে আরও করেছেন। আর এখন মুখ্যমন্ত্রী বা তৃণমূল নেত্রী হিসাবে তাঁর অবস্থান যেখানে, তাতে অনায়াসে ধরে নেওয়া যায়, আগামিকালের ব্রিগেডও সব দিক থেকে ভরপুর থাকবে।

আপাতভাবে এই ভিড় জনসমর্থনের মাপকাঠিও। তাই লোকসভা নির্বাচনের প্রাক-পর্বে এমন একটি সমাবেশের মধ্য দিয়ে তৃণমূল নেত্রী নিজের ‘জোর’ আরও এক বার যাচাই করে নিতে চাইবেন এবং প্রতিপক্ষকেও তা ‘দেখিয়ে’ দেবেন— এটাই স্বাভাবিক। তবে এ সবই মূলত রাজ্যের নিরিখে প্রযোজ্য।

প্রকৃতপক্ষে এ বারের ব্রিগেড সমাবেশ কিন্তু গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যের দিক থেকে আগের সমাবেশগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা। কারণ দেশের তাবড় নেতাদের উপস্থিতিতে এই মঞ্চ জাতীয় রাজনীতিতে মমতার ভিত মজবুত করার এক উৎকৃষ্ট সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে যা হতে পারে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

কী ভাবে? সেই আলোচনার মুখবন্ধ হিসাবে সমগ্র পরিপ্রেক্ষিতটি এক বার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

সূচনা গত বছর তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে। মমতা সেখানে কিছুটা আকস্মিক ভাবেই ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডের ডাক দিয়েছিলেন। এতই আচমকা, যে তাঁর দলের শীর্ষ নেতাদের কাছেও তখন পর্যন্ত বিষয়টি অজানা ছিল। ‘২০১৯-এ বিজেপি ফিনিশ’ ইত্যাদি বলতে বলতে হঠাৎ ১৯ জানুয়ারি তারিখটি তিনি ব্রিগেড সমাবেশের জন্য ঘোষণা করে দেন।

সেই সভামঞ্চের চেহারা কী হবে, বিরোধী নেতাদের ক’জন আসবেন, সবই সে দিন ছিল অনিশ্চিত। মূল ভাবনায় তখন বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলিকে একজোট করা। যাকে বলা হল, ফেডারাল ফ্রন্ট। বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিতে ওই ফ্রন্টের কথাও প্রথম শোনা গেল মমতার মুখেই। সেই সঙ্গেই প্রশ্ন উঠল, কংগ্রেসের নেতৃত্ব ছাড়া বিজেপি-বিরোধী জোট কি আদৌ সম্ভব?

সেই প্রশ্ন আজও একেবারে মিইয়ে গিয়েছে, তা নয়। কিন্তু এটা যে একেবারে অসম্ভব, তেমন কথাও হয়তো খুব জোর দিয়ে বলা যাবে না। বস্তুত মমতার বক্তব্য ছিল, যেখানে যে রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে যে দল প্রধানত শক্তিশালী সেখানে তারা লড়াই করবে এবং অন্যেরা তার পিছনে দাঁড়াবে। সে ক্ষেত্রে যেখানে কংগ্রেস বড় শক্তি, সেখানে প্রাধান্য পাবে তারাই। সেই যুক্তিতে তিনি এখনও স্থিত।

সন্দেহ নেই, পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে মমতার এই পরিকল্পনার পিছনে একটি বড় কারণ অবশ্যই সংখ্যালঘু ভোট। এখানে প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ মমতার পক্ষে থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়। সহজ অঙ্কে বিজেপির মোকাবিলায় ওই ভোট ‘অমূল্য’। মুখে প্রকাশ না করলেও রাজ্যে ‘দুর্বল’ কংগ্রেসকে সেই ভোটের ভাগ দিতে না-চাওয়া তৃণমূল নেত্রীর দিক থেকে তাই খুব অসঙ্গত নয়। তা ছাড়া এটাও তো ঠিক যে, বিজেপি, কংগ্রেস ও বাম তিন পক্ষের বিরুদ্ধে একা লড়াই করেও মমতা দেখিয়ে দিতে পেরেছেন, তিনি একক শক্তিতে রাজ্যে বিরাজমান। ফলে নিজের আধিপত্য ছেড়ে দেওয়ার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তাঁর না থাকারই কথা।

কিন্তু ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও ছবিটা খুব আলাদা নয়। বিরোধী ঐক্যের ক্ষেত্রে মমতা যে সাধারণ সূত্র দিয়েছেন, কালক্রমে তার বাস্তবতা অন্যত্রও সামনে আসছে। হিন্দি বলয়ের চার রাজ্য এবং মিজ়োরামে সাম্প্রতিক ভোটের ফলে তা অনেকটা প্রতিফলিত। যেমন, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ়ে বিজেপিকে গদি-ছাড়া করেছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। আবার তেলঙ্গানা ও মিজ়োরামে দুই আঞ্চলিক দলের জয়জয়কার। কর্নাটকেও দেবগৌড়ার দলকে বাদ দিয়ে একা কংগ্রেসের পক্ষে সরকার গড়া সম্ভব ছিল না। তামিলনাড়ু, কেরলের মতো দক্ষিণের রাজ্যগুলিতেও কংগ্রেস একক জোরে লড়ার জায়গায় নেই। সর্বোপরি উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসকে বাদ রেখে মায়াবতী ও অখিলেশ আসন ভাগাভাগি করে নেওয়ার পরে রাহুল গাঁধীর পক্ষে পরিস্থিতি কতটা সুবিধাজনক হবে, বলা বেশ কঠিন।

এই অবস্থায় কিছু দিন ধরেই আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে মমতার যোগাযোগ বাড়ছে। নিয়মিত বিভিন্ন রাজ্যের অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ও শীর্ষনেতাদের ফোন আসে মমতার কাছে। মমতাও তাঁদের ফোন করেন। এমনকি কংগ্রেসের উপরতলাতেও ফোনে বা এসএমএসে এখন কথা চালাচালি করেন তৃণমূল নেত্রী। আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই— বিরোধী জোট প্রসারিত করা।

কিন্তু খুব সচেতন ভাবেই তাঁদের কেউ কখনও জোটের নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলেন না। বরং সবটাই ভোটের পরে অবস্থা অনুযায়ী ঠিক হবে বলে কথা অসমাপ্ত রাখেন। এটাই বোধ হয় মমতার পক্ষে একটা বড় সুবিধার দিক। কারণ এখনও পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে তাঁর দিক থেকে হারানোর বিশেষ কিছু নেই। লাভের পাল্লাই বরং তুলনায় ভারী।

কেন? এক এক করে দেখা যাক। প্রথম, কংগ্রেসের প্রসঙ্গ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলির মধ্যে একমাত্র কংগ্রেস ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে মমতার সরাসরি কোনও রাজনৈতিক লেনদেন হওয়ার প্রশ্নই ওঠার কথা নয়। তবে এই রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের নির্বাচনী সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কোন বাঁক নেবে, সেটা এমন একটা বিষয়, যা এখনও খুব পরিষ্কার নয়। রাজ্য কংগ্রেসের কতিপয় নেতার পরামর্শে দিল্লি এখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়ে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সোনার পাথরবাটি সাজাবে, না কি সিপিএমের সঙ্গে জোট গড়ে ২০১৬-র মতো মাসুল গুনবে, অথবা অন্য কোনও পথ খুঁজবে—সবটাই অজানা। কিন্তু কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেন, দেশে অ-বিজেপি সরকার তৈরির জন্য মমতার সমর্থন লাগবে না? যদি সেটাই বাস্তবতা হয়, তা হলে মমতার সঙ্গে সম্পর্ক ‘তিক্ত’ করে রাখলে লাভ কার? সোমেন মিত্রদের ইচ্ছাপূরণের জন্য রাহুল গাঁধী আদৌ কতটা ‘আত্মত্যাগ’ করতে রাজি হবেন, সময় বলবে। আপাতত জল্পনা জিইয়ে থাক।

দ্বিতীয়, অন্য বিরোধী দলগুলির অবস্থান। আগেই বলেছি, মমতা যে সব বড় আঞ্চলিক দলকে নিয়ে জোট গড়ে এগোতে চাইছেন, তারা কেউ এই রাজ্যে ভোট লড়তে আসে না। মমতাও তাদের রাজ্যে প্রার্থী দিতে যান না। ফলে তাদের মধ্যে ভোট কাটাকাটির বিবাদ বা ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা শূন্য। উল্টো দিকে পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে ওই দলগুলির মধ্যে কেউ কেউ অন্য রাজ্যেও প্রার্থী দিয়ে থাকে। জাতপাতের ভোট, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি নানা কারণে তাঁদের কয়েকজনের মধ্যে ভিতরে ভিতরে টানাপড়েনও আছে। মমতা সে দিক থেকে কিছুটা ‘নির্বিবাদ’ জায়গায়।

তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আসনসংখ্যা। বিরোধী শিবিরে আপাতনজরে সবচেয়ে বড় দল কংগ্রেস। কিন্তু এখন বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলের উত্থান এবং দলগত ভারসাম্যে বিবিধ বদলের সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের প্রভাব কমেছে। একক শক্তিতে ক্ষমতা পাওয়া দূরের কথা, তারা কত বেশি আসন পেতে পারে সেই প্রশ্নেও খুব আত্মবিশ্বাসী জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এই রাজ্যে ৪২টি আসনের মধ্যে মমতার পক্ষে একা যত বেশি সংখ্যক জেতার সম্ভাবনা আছে, অন্যান্য রাজ্যে কোনও আঞ্চলিক দলের একক ভাবে হয়তো ততটা নেই।

এই সব কিছু সামনে রেখে বলা যেতেই পারে, তৃণমূল নেত্রী তুলনায় স্বস্তিকর জায়গায় রয়েছেন। তাই তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝেই বিরোধী নেতারা ব্রিগেড-মুখী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE