Advertisement
E-Paper

ওঁরা ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবেন

সুনাগরিক গড়ে তোলার দায় অবশ্যই শিক্ষকের। কিন্তু যে শিশু ক্ষুধায় কাতর, অপুষ্টিতে ভোগে, তাকে সুস্থ না রাখলে শিক্ষা দেওয়ার নামে তো শাস্তি দেওয়া হয়।

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৪৮

শিক্ষক সংগঠনের ঘোষিত নীতি শিক্ষা ও শিক্ষক স্বার্থে কাজ করা। নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির (এবিটিএ) প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২১ সালে, এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ১৯৫৪ সালে এবিটিএ-র পতাকাতলে ঐতিহাসিক শিক্ষক আন্দোলনে অংশ নেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশ দাসরা। তার পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। সকলের জন্য শিক্ষা এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতনের দাবি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছে। এসেছে শিক্ষা অধিকার আইনও। একদা এক জন প্রাথমিক শিক্ষক যা বেতন পেতেন তার দ্বিগুণ মাইনে ছিল এক জন ডাকপিয়নের। এ কালের শিক্ষকদের মাইনে, অন্য পাঁচটা পেশার তুলনায়, যথেষ্ট না হলেও, অকিঞ্চিৎকর বলা চলে না। কিন্তু শিক্ষকদের, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন যেন ক্রমে বড় হচ্ছে।

এ দিকে, অভিযোগ বেড়েই চলেছে— শিক্ষার মান নেমেছে, ছাত্রছাত্রীরা দু’কলম লিখতে-পড়তে পারে না, পারে না যোগ-বিয়োগ। স্কুল হয়ে উঠেছে খিচুড়ি স্কুল, অর্ধেক দিন ঝাঁপ বন্ধ। প্রাইভেট টিউশনের বাজার ফেঁপে উঠেছে। শিক্ষকদের, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার প্রতি সমাজের সমর্থন আজ আর নেই যেন। কেন?

সুনাগরিক গড়ে তোলার দায় অবশ্যই শিক্ষকের। কিন্তু যে শিশু ক্ষুধায় কাতর, অপুষ্টিতে ভোগে, তাকে সুস্থ না রাখলে শিক্ষা দেওয়ার নামে তো শাস্তি দেওয়া হয়। তাই তার খিদে তাড়াতে, পুষ্টির জন্য, তাদের সকলকে একাসনে বসার অধিকার দিতে মিড-ডে মিল। তার আয়োজন দেখে কেউ কেউ বলছেন খিচুড়ি স্কুল। তাঁরা এর সামাজিক গুরুত্ব বুঝেও বোঝেন না। বলেন, এত করেও তো অপুষ্টি যায় না। যাবে কেমন করে? সরকারি অর্থে যে পরিমাণ ক্যালরি আর প্রোটিন পায় শিক্ষার্থী, তা আদৌ যথেষ্ট নয়। কিন্তু সে কথা বলে সরকারকে চাপ দেয় কে? প্রতিকারের পথ খোঁজে কে? চালডালের হিসেব রাখতে, খাদ্যের মান ঠিক রাখতে শিক্ষকের প্রাণ যায়। তবু, তাঁকে পেতে হয় চোর অপবাদ। মিড-ডে মিলের হিসাব থেকে জনগণনা ইত্যাদি হাজার কাজে সাড়া না দিলে চাকরি থাকে না, সেই সব শিক্ষাবহির্ভূত কাজ করতে বিদ্যালয় যদি বন্ধ হয় তবে ফাঁকিবাজ বলে চিহ্নিত হন তাঁরা।

এই রাজ্যের প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দলের অন্তত একটি করে অনুগত শিক্ষক সংগঠন রয়েছে। আনুগত্য বড় দায়। কোপ মারার আগে ঝোপের রং দেখতে হয়। মাইনে বাড়ানোর দাবি জানানো সোজা, কিন্তু শিক্ষাদানের সমস্যার কথা, শিক্ষার সমস্যার কথা বলবে কে, কাকে, কখন? মূলস্রোতের শিক্ষক সংগঠনগুলি এ সব সমস্যার কথা ভুলে থাকে, এড়িয়ে চলে, খুব বেশি হলে বার্ষিক সভায় সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করে দায়িত্ব সারে। এতেই তুষ্ট থেকে জয়ধ্বনি দিতে হয় নেতার নামে, দলের নামে।

দীর্ঘ দিন এই বৃত্তে থেকে, এই সব দেখে দুঃখ ও ক্ষোভ বাড়ছিল। অন্য রকম স্কুল, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, শিক্ষার স্বার্থে কাজ করা শিক্ষক সংগঠনের সন্ধানে ছিলাম। সম্প্রতি বালুরঘাটে প্রতীচী ট্রাস্টের প্রত্যক্ষ সহযোগে গড়ে ওঠা ‘শিক্ষা আলোচনা’ (এই বছরের টেলিগ্রাফ পুরস্কার বিজয়ী) নামের প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি ছোট সংগঠনের বার্ষিক সভায় যোগ দিয়ে দুঃখ ও ক্ষোভ অনেকটা দূর হল।

দু’দিনের আলোচনায় যোগ দিতে এসেছিলেন কুড়িটা জেলার প্রায় সওয়া দুশো শিক্ষক প্রতিনিধি। যে রাজ্যে প্রাথমিকে শিক্ষক সংখ্যা প্রায় পৌনে দু’লক্ষ, সেখানে সওয়া দুশো আর এমন কী? কিন্তু, তাঁরা এসেছিলেন আপন আপন খাট-বিছানা-সংসার ফেলে, গাঁটের কড়ি খসিয়ে, নানা অসুবিধা আছে জেনেও। কেউ ওরই মধ্যে গান লিখলেন, সুর দিলেন, গাইলেন, আবৃত্তি করলেন, ছড়িয়ে দিলেন প্রত্যয়ের বার্তা। ওঁরা আলোচনা করলেন শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, মিড-ডে মিলের সমস্যা, পাশ-ফেলের সমস্যা, ‘অবৈতনিক শিক্ষা’ তথা শিক্ষানীতির নানা দিক, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা অধিকার ও ‘আধার কার্ড’, শিশু মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি। কেউ গণিত উৎসব করেছেন তো কেউ আয়োজন করেছেন ভাষা উৎসবের; কেউ শিক্ষার্থীদের তারা চেনাতে সাহায্য করেছেন; কেউ মায়েদের দিয়ে দেওয়াল পত্রিকা চালান, নাটক করান, কেউ আবার আয়োজন করেছেন শিশুমেলা। পরিবেশ চর্চা আর কমিউনিটি লাইব্রেরিও আছে তাঁদের কর্মযজ্ঞে। অনেকে সঙ্গে করে এনেছেন নিজের বিদ্যালয়ের পত্রিকা, যেখানে কোনও শিশু লিখেছে, ‘আমাদের বিদ্যালয় আমার খুব প্রিয়। আমি পাই বন্ধুবান্ধবদের ভালবাসা’; কেউ লিখেছে, ‘ঐ এল ঝড়/ খোকা খাবে পেট পুরে/ দুটি আম পড়’। কোনও পত্রিকার নাম স্বপ্নপূরণ, কেউ নাম রেখেছে মুক্তাকাশ।

কেবল ‘অ-আ-ক-খ’ বা সংখ্যা চেনানো নয়, বাক্য পাঠ বা গণনা নয়, আরও কিছুতে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের জুড়তে চান ওঁরা। একে অন্যকে পরামর্শ দিলেন কেমন করে অল্প জায়গাতেও মাশরুমের মতো কিছু ফলানো যায়। এক জনও তুললেন না বকেয়া ডিএ-র কথা, বেতন কমিশনের কথা। অথচ, অর্থকষ্ট তাঁদেরও আছে। কিন্তু তাঁরা মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করেন, শিশুরা ভাল থাকলেই তাঁরা ভাল থাকবেন। আর সেই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতেই উদ্যোগী হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের কাছে শিখলাম অনেক কিছু। এক জন বললেন, বাল্যবিবাহ যদি থাকে, অপুষ্ট শিশু জন্মাবে। আর, জানতে চাইলেন, তেমন জাতকের অপুষ্টি কি মিড-ডে মিল দূর করতে পারে?

বালুরঘাট থেকে প্রায় চোদ্দো কিলোমিটার দূরের চেঁচাই প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখে এলাম। ‘অজ পাড়াগাঁ’র স্কুল। রাজ্যের সমস্ত শিক্ষকদের কাছে প্রার্থনা জানাই, দেখে আসুন। বুঝবেন, ‘ইচ্ছায় কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায়’। এক দিকে জেলা প্রশাসন, অন্য দিকে গ্রামসমাজ— সবাইকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলের শিক্ষকরা যেন এক স্বপ্ন রচনা করায় ব্যস্ত। অমর্ত্য সেন যখন প্রতীচী ট্রাস্ট গড়েন, অনেকের প্রশ্ন ছিল, এ সব করে কী হবে? গবেষণা ও কর্মোদ্যোগের মেলবন্ধন, এবং মানুষের সক্ষমতা বাড়ানোর উপর তিনি সারা জীবন যে জোর দিয়ে এসেছেন, তার যে একটা বড় সুফল হতে পারে, তা দৃষ্ট হল ‘শিক্ষা আলোচনা’-র সভায়। কেবল সংহতি নয়, এক দিকে আপন কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং অন্য দিকে জ্ঞানভিত্তির আলোচনামূলক প্রসারের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সংহতিই পারে স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে সেতুনির্মাণ করতে।

teachers School Children Education
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy