Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

হিসাব চাই

এই রায়টি সাংসারিক ক্ষেত্রে একটি ছোটখাটো বিপ্লব ঘটাইতে সক্ষম। কারণ ‘সংসার’-এর অনেক হিসাব তাহা পাল্টাইয়া দিবার ক্ষমতা রাখে।

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৮ ০০:১৫
Share: Save:

স্বামীর রোজগারে স্ত্রীর অধিকারের ধারণা আধুনিক ভারতে, বিশেষত নাগরিক সমাজে, মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। অন্তত আইনের দৃষ্টিতে। কিন্তু সমস্যা হইল, উপার্জনের অঙ্কটি ঠিক কত, বহু স্ত্রী-ই সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। মাসান্তে তাঁহারা শুধুমাত্র সংসার চালাইবার খরচটুকুই স্বামীর নিকট হইতে পাইয়া থাকেন। তাহার অধিক জানিবার কোনও উপায় নাই, কারণ স্বামীর উপার্জন জানিবার অধিকারটি এখনও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বরং প্রকৃত রোজগার স্ত্রীর নিকট গোপন রাখিবার প্রবণতাটিই অনেকের নিকট স্বীকৃত প্রথাস্বরূপ। এই প্রথার গোড়ায় আঘাত করিয়াছে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের সাম্প্রতিক একটি রায়। রায়ে আদালত জানাইয়াছে, স্বামীর উপার্জন জানিবার সম্পূর্ণ অধিকার স্ত্রীয়ের আছে। এবং তাহার পরিমাণ শুধুমাত্র মুখে জানাইলে চলিবে না, রীতিমতো পে স্লিপ-সহ তাহার প্রমাণ দিতে হইবে।

এই রায়টি সাংসারিক ক্ষেত্রে একটি ছোটখাটো বিপ্লব ঘটাইতে সক্ষম। কারণ ‘সংসার’-এর অনেক হিসাব তাহা পাল্টাইয়া দিবার ক্ষমতা রাখে। অধিকাংশ ভারতীয় পরিবারে স্বামী যতই উপার্জন করুন না কেন, স্ত্রী একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থই সংসার চালাইবার জন্য হাতে পাইয়া থাকেন। ওই পরিমাণ অর্থের মধ্য হইতেই সাধারণত তিনি সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ সামাল দেন। তাহার বাহিরে কী পরিমাণ টাকা সংসারে ঢুকিল না, এবং তাহা কোন অকাজে ব্যয় হইল তাহার হদিস তিনি জানিতে পারেন না। অথচ ওই পরিমাণ টাকার কিছুটাও স্ত্রীয়ের হাতে পড়িলে হয়তো সংসারটি আরও কিছু মসৃণ ভাবে চলিতে পারিত, বিপদের দিনের জন্য হাতে কিছু বাড়তি অর্থও থাকিত। নোটবন্দি প্রমাণ— মধ্যবিত্ত ঘরের বধূরা অনেকেই স্বামীর পকেট হইতে টাকা সরাইয়াও তাহা নিজ শখের পিছনে নহে, বরং সংসারের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের কথা ভাবিয়াই তোশকের তলায়, চালের টিনে বা শাড়ির ভাঁজে জমাইয়া রাখেন। অন্য দিকে, স্বামীর প্রকৃত উপার্জন জানিবার একটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত প্রয়োজনও আছে। ইহাতে বিবাহবিচ্ছিন্ন মেয়েদের পক্ষে খোরপোশ বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থের দাবি জানাইতে সুবিধা হইবে। বস্তুত, যে মামলাটির প্রেক্ষিতে এই রায়টি দেওয়া হইয়াছে সেই মামলায় আবেদনকারিণীও এই মর্মেই আবেদন জানাইয়াছিলেন। তাঁহার প্রাক্তন স্বামী উচ্চ রোজগেরে হওয়া সত্ত্বেও তিনি সামান্য অর্থই মাসিক খোরপোশ পাইতেন। তাঁহার অবস্থা অন্য বিবাহবিচ্ছিন্নাদের ক্ষেত্রেও হামেশাই ঘটিয়া থাকে। আশা, এই রায় তাঁহাদেরও পথ দেখাইবে।

একটি প্রশ্ন তোলা যাইতে পারে। শুধুমাত্র স্ত্রী কেন? স্বামীরও তো উপার্জনক্ষম স্ত্রীয়ের রোজগার জানিবার অধিকার থাকা উচিত। যদি ধরিয়া লওয়া যায়, সংসার কোনও এক জনের নহে, বরং যৌথ দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ দিয়া গড়িয়া উঠে, তাহা হইলে তো উভয়েরই উভয়ের আয়-ব্যয় সম্পর্কে এক পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা উচিত। ইহা শুধুমাত্র অধিকারের প্রশ্ন নহে, এক পারস্পরিক বিশ্বাসের প্রশ্ন, যে বিশ্বাস না থাকিলে সংসার সম্পূর্ণ হয় না। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় অবিশ্বাসই ধর্ম। আইন-আদালতের নির্দেশ সেই ধর্ম বদলাইতে পারে না, তবে বদলাইবার পথে অনুঘটকের কাজ করিতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Husband Wife Salary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE